• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
রমজানের শেষ দশকের গুরুত্ব

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

রমজানের শেষ দশকের গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ০৫ মে ২০২১

প্রতিটি শুরুর শেষ থাকে। থাকে পাওয়ার আনন্দ, হারানোর বেদনা। এইতো সেদিন শুরু হলো মাহে রমজান। মুসলিম বিশ্ব আনন্দে আত্মহারা। সে আনন্দ দিনে দিনে ফুরিয়ে আসছে। বিদায়ের বেদনা দিচ্ছে। সময় এখন প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব মিলানোর। কি প্রত্যাশা ছিল? কতটুকু অর্জন হলো? অপরাধের ক্ষমা কি করাতে পেরেছি? নাজাতের ফরমান কি লাভ করতে পারছি? আমাদের সংস্কৃতিটা ভিন্ন। রমজান শুরু করি উদ্যোমী হয়ে। শেষ করি হেলা-অবহেলা করে। শেষকে কীভাবে শেষ করতে হয় আমরা অনেকে জানিনা সেটা। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে শিখিয়েছেন। নিজে করে দেখিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রমজানের শেষ দশকের আমলের বর্ণনা দিতে গিয়ে হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য দিনগুলোর তুলনায় রমজানের শেষ দশকে বেশি ইবাদত করতেন। (সহিহ মুসলিম- ১১৭৫) তিনি আরো বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে পূর্ণ রাত জাগতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন এবং নিজে কোমর বেঁধে (গুরুত্ব দিয়ে) ইবাদতে মগ্ন হতেন। (সহিহ বুখারি-২০২৪)

হাদিস থেকে রমজানের শেষ দশকের গুরুত্ব স্পষ্ট প্রতীয়মান। মিল-অমিলের জায়গাটা এখানেই। রাসুল-সাহবাগণ যখন শেষ দশকে ইবাদতে ভিন্ন গুরুত্ব দিতেন। আমরা তখন শপিং সাংস্কৃতিতে ব্যস্ত। বাড়ির সৌখিন্য, ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনে মত্ত। বুড়ো, যুবক, পৌড়, সবাই জাগতিক বিষয়ে মশগুল। আর বিপরীত লিঙ্গগুলো মহামশগুল। প্রসাধনী যেন না হলেই নয়। ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় লিপ্ত। রাত-দিন লাভের  আশায় আবিষ্ট। শেষ দশক যে আখেরাতের ব্যবসার উপযুক্ত সময় সে কথা ভাববার ফুরসত কই! শ্রমিক তো দিন শেষে প্রারিশ্রমিক পাই। রোজা থেকে দিনভর না খাওয়ার ক্লান্তি, রাত জাগার কষ্ট। এসবের প্রতিদান তো আল্লাহ শেষ সময়ে দেবেন। অথচ উপযুক্ত সময়ে আমরা বিমুখ হয়ে পড়ি। আমাদের ইবাদতে হয় তাড়াহুড়া। অনেকে হয় একেবারেই মসজিদ ছাড়া। মানবিক প্রয়োজন  মানবের আছে। থাকবে হায়াত পর্যন্ত। তবে সেটাকে রাখতে হবে সীমাবদ্ধ। প্রাধান্য দিতে হবে আখেরাতকে। আল্লাহতায়ালা  পবিত্র কোরআনে ইরশাদ  করেছেন, ‘বরং তোমরা দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখেরাত অধিক উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সুরা আ’লা) ‘সাগরের দুটি ধারা বহমান। লবণ ও মিষ্ট পানি; পাশাপাশি প্রবাহমান। একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয় না। রক্ত, গোবর ভেদ করে গাভীর স্তনে দুধ নামে। দুধ সে রক্ত, গোবর স্পর্শ করে না।’ এগুলো কোরআনের বর্ণনা। এখানে আছে আমাদের জন্য মহাশিক্ষা।

দুনিয়া আখেরাত দুটো পাশাপাশি। দুনিয়া থেকেই আখেরাত সঞ্চয় করতে হবে। সাবধানে, সতর্কে। দুনিয়ার মায়া, মমতা, লালসাকে স্পর্শ না করে। এখানে আমরা কতটা সফল? শেষ দশকে আছে বরকতপূর্ণ রাত। লায়লাতুল কদর। এরাত মহিমান্বিত। সম্মানিত। ‘লাইলাতুল কদর’ কোরআন নাজিলের রাত। এরাত হাজার মাস হতে শ্রেষ্ঠ। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; ‘তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা পর্যন্ত।’ (সুরা আল কাদর, আয়াত : ১-৫) যে মুমিন কদরের রাত পেল সে ভাগ্যবান। হাদিসে আছে-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শবে কদরের সন্ধানে রমজানের প্রশম দশক এতেকাফ করলেন। কিন্তু পেলেন না। দ্বিতীয় দশক এতেকাফ করলেন। এবারো পেলেন না। তারপর শেষ দশক এতেকাফ করলেন। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা শেষ দশকে বেজোড় রাতগুলোতে কদর অন্বেষণ করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২০১৬)

কদরের রাতে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে  ক্ষমা চাইতে হবে। নিভৃতে নির্জনে দরবারে ইলাহিতে অশ্রু ঝরাতে হবে। আবেগ, অনভূতি, আকুতি, মিনতি হূদয়ে উজাড় করে মালিকের কাছে চাইতে হবে। হাদিস শরিফ থেকে স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়; বান্দা যদি পূর্ণ আশা নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, আল্লাহ সেই বান্দাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৩৪) কদরের রাতে আমরা সমস্ত কল্যাণের দোয়া করব। তবে বিশেষভাবে হাদিসে শেখানো দোয়াটি করব। আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন; তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজা, সহিহ-আলবানি) সাধারণত ২৭ রমজানকে শবে কদর বলে প্রচার করা হয়। মিডিয়া এবং দায়িত্বশীলগণ এবিষয়ে  উদাসীন। পুরোনো কথাই প্রচার করে। সরকারি ছুটিও ঘোষিত। যদিও ২৭ তারিখের  একটি মত আছে, তবে নির্দিষ্ট নয়। তাই আমাদের নির্দিষ্ট করা অনুচিত।

প্রবাদ বাক্য প্রসিদ্ধ ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। বলা যায় রমজানের সফলতার সূত্রমূল শেষ দশক। তাই আমাদের একান্ত কর্তব্য রমজানের শেষ সময়টুকুর বিষয়ে যত্নবান হওয়া। প্রয়োজনীয় কাজ অবশ্যই সারতে হবে। তবে প্রয়োজন যেন হয় পরিমিত। শেষ দশকের আরো একটি ইবাদত হলো এতেকাফ। প্রতি মসজিদে একজন অবশ্যই সুন্নাত ইতেকাফ করবে। ইতিকাফকারী এক নামাজের পর অন্য নামাজের অপেক্ষায় থাকে। আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে এবং নামাজ তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।’ (মুসলিম, হাদিস নং-৬০১১) হজরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফকারী সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘যে ইতেকাফ ও মসজিদে আবদ্ধ থাকার কারণে সব পাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং তার নেকির হিসাবের মধ্যে সর্বপ্রকার নেকি সম্পাদনকারীর ন্যায় নেকী অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।’ (ইবনে মাজা)

শেষ দশকে আমলযোগ্য আরেকটি কাজ হলো, সাদকাতুল ফিতর আদায় করা। সামর্থ্যবানেরা ঈদগায়ে যাওয়ার পূর্বে সাদকাতুল ফিতর আদায় করবে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা পালনকারীর জন্য সদকাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন, যা রোজা পালনকারীর অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ পরিশুদ্ধকারী এবং অভাবী মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে এটা আদায় করবে, তা সাদকাতুল ফিতর হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা অপরাপর (নফল) সাদকা হিসেবে গৃহীত হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-১৬০৯) হজরত জারির (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজা সাদকাতুল ফিতর আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত আসমান-জমিনের মাঝে ঝুলন্ত থাকে।’ (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব : ২/৯৬)

পরিশেষে কামনা করি নিয়ম প্রথার ঊর্ধ্বে গিয়ে সবার শেষ দশক হোক প্রাণবন্ত। মুসলিমদের প্রতিটি ঘর ভরে উঠুক ইবাদতের জ্যোতিতে। হূদয়, মন হোক আলোকিত। সবাই জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ নিয়ে হোক চিরস্থায়ী জান্নাতের মালিক। আমিন!

হাসান মুরাদ

লেখক : খতিব, ভিমরুল্লা শাহী জামে মসজিদ, চুয়াডাঙ্গা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads