• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের সুন্নাহ তরিকা

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের সুন্নাহ তরিকা

  • প্রকাশিত ১১ মে ২০২১

মো. সাইফুল মিয়া

ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম সাম্যের শিক্ষা দেয়। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিন ধনী-গরিব সকলের যেন সমানভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সেজন্য মহান আল্লাহতায়ালা সাদাকাতুল ফিতরের বিধান দিয়েছেন। ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আরবি শব্দ। সাদাকা মানে দান আর ফিতর মানে রোজা ভেঙ্গে পানাহারের বৈধতা। দীর্ঘ এক মাস পর রোজা ভাঙা উপলক্ষে গরিব- মিসকিনকে যা দান করা হয়, তাই সাদাকাতুল ফিতর। আমাদের দেশে সাদাকাতুল ফিতর ‘ফিতরা’ নামেও পরিচিত।

সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার ফজিলত : আল-কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের রাসুল যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক।’ (সুরা হাশর-৭) হাদিসের ভাষ্য মতে, সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের কারণ হচ্ছে দুইটি। এক. রোজার কাফফারা অর্থাৎ রোজায় আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়, সাদাকাতুল ফিতরের মাধ্যমে  ক্ষতিপূরণ হয়। দুই. ঈদের দিন গরিব ও অসহায় লোকদের সহযোগিতা করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সাদাকাতুল ফিতর আব্যশক করেছেন। অনর্থক, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণের জন্য এবং গরিব ও অসহায় লোকদের সহযোগিতা করার জন্য।’ (সুনামে আবু দাউদ, হাদিস নং-১৬০৯) আরেক বর্ণনায় এসেছে, হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের রোজা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার পূর্বপর্যন্ত আসমান-জমিনের মাঝে ঝুলন্ত থাকে।’ (আত-তারগিব ওয়াত তাবহির : ২/৯৬) উপরে উল্লিখিত দুইটি হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারছি, একজন রোজাদার ব্যক্তির জন্য সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

কার ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব : সাদাকাতুল  ফিতর একটি আর্থিক ইবাদত। তাই এটি আদায় করা সবার জন্য আবশ্যক নয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। নিসাব হচ্ছে ওই পরিমাণ সম্পদ যা থাকলে জাকাত আদায় করা ফরজ। তবে জাকাত আর সাদকাতুল ফিতরের পার্থক্য হলো, জাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। আর সাদকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে ঈদের সকালে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকলেই সাদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। হিসাব অনুসারে, নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ কিংবা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ নগদ অর্থ। নিসাবের অংশ ৩টি, তা হলো- স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ অর্থ। এখন যদি কারো শুধু স্বর্ণ বা শুধু রৌপ্য কিংবা শুধু নগদ অর্থ কোনোটিই দ্বারা নিসাব পূর্ণ না হয়, এক্ষেত্রে যে কোনো একটিকে নিসাব ধরে অন্যগুলো নিসাব পণ্যের মূল্য হিসেবে ধরতে হবে। তখন যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে তার ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।

পরিবারের কার কার পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব : সাদাকাতুল  ফিতর মুসলমান নর-নারী, ছোট-বড় সবার জন্য আদায় করা ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে হজরত ইবনে ওমর (রা) বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সবার ওপর এক সা পরিমাণ খেজুর ও যব সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে আব্যশক করা হয়েছে এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। এ হাদিসের আলোকে আমরা বলতে পারি, ব্যক্তি নিজ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান, অবিবাহিত মেয়ে, ভরণপোষণ করে এমন এতিমের সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা পরিবারের কর্তার ওপর ওয়াজিব। স্ত্রী ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে আদায় করা উত্তম। উল্লেখ্য, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা) -এর শাসনামলে গর্ভে থাকা সন্তানেরও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন।

কখন সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয় : সাদাকাতুল ফিতর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিব হয়ে যায়। তাই কেউ যদি সেদিন সুবহে সাদিকের আগে জন্ম হয় বা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়ে যায়। আবার কেউ যদি সুবহে সাদিকের আগে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে না। হাদিসের বর্ণনা মতে, ঈদুল ফিতরের নামাজে যাওয়ার আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। ঈদের নামাজের পর তা আদায় করলে সাদাকাতুল ফিতর আদায় হবে না; বরং সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে। একই সাথে কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ঈদুল ফিতরের ২/১ আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করেছেন। তাই, আমরা চাইলে ঈদুল ফিতরের ২/১ দিন আগেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারি।

সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ : হাদিসের আলোকে ৫ টি জিনিস দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে। তা হলো যথাক্রমে-যব, কিসমিস, খেজুর, পনির ও গম। এগুলোর মধ্যে গম হচ্ছে আধা ‘সা’ আর বাকিগুলো এক ‘সা’। ‘সা’ হচ্ছে একটি প্রাচীন ওজন পদ্ধতি। বর্তমান পরিমাপে ১ ‘সা’-এর পরিমাণ ৩ কেজি ২৭০.৬০ গ্রাম। আর আধা ‘সা’-এর পরিমাণ হচ্ছে ১ কেজি ৬৩৭ গ্রাম। মনে রাখার সুবির্ধাতে ইসলামি চিন্তাবিদগণ ১ ‘সা’কে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম এবং আধা ‘সা’কে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বলে থাকেন। প্রতি বছর ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে সাদাকাতুল ফিতরের  সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ জন্য ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে স্বাগতম জানিয়েছে। এবছর ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ২৩১০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৭০ টাকা নির্ধারিত করা হয়েছে।

কে সাদাকাতুল ফিতর পাবে : সাদাকাতুল ফিতর হচ্ছে গবির ও অসহায় লোকদের অধিকার। তবে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ গরিব ও অসহায় থাকলে, তাকে সাদাকাতুল ফিতর দেওয়া সবচেয়ে উত্তম কাজ। এমন কি যদি ভাই-বোনের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকে, তাহলে তাদেরকেও সাদাকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে। এতে সাদাকাতুল ফিতর আদায় হবে পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনের দেখাশোনা করার হকও আদায় হবে। একজনের সাদাকাতুল ফিতর একজনকে দেওয়া উত্তম। তবে সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ বেশি ২/৩ জনকে দেওয়া যাবে। সাদাকাতুল ফিতর ধনী ব্যক্তিদের দয়া নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব। তাই সাদাকাতুল ফিতর আদায়কারী ব্যক্তি নিজে গরিব অসহায় লোকদের বাড়িতে পৌঁছে দিবে।

প্রচলিত একটি ভুল ধারণা : হাদিসে বর্ণিত সাদাকাতুল ফিতরের  পণ্যগুলোর এ বছরের বাজার মূল্য হচ্ছে-গম ৭০ টাকা, যব ২৮০ টাকা, কিসমিস ১৩২০ টাকা, খেজুর ১৬৫০ টাকা এবং পনির ২৩১০ টাকা। বর্তমানে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে সর্বত্র গমের মূল্যই বিদ্যমান। যব, কিসমিস, খেজুর ও পনিরের সামর্থ্য থাকার পরও অনেকে গমের মূল্যে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে থাকে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, গমের মূল্যে সাদাকাতুল ফিতর আদায় হবে কিনা? অবশ্যই হবে। তবে মনে রাখবেন, আপনি সাদাকাতুল ফিতর আদায় করছেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য। এখন চিন্তা করেন, আল্লাহকে আপনার সামর্থ্যের মধ্যে কি রকম দান করা উচিত। প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সর্বোত্তম দান হলো, যা দাতার নিকট সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্য সবচেয়ে বেশি।’ (বুখারি) তাই আমাদের সবার উচিত নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। যাতে গরিব ও অসহায় লোকদের মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা যায় এবং রোজার ভুল-ত্রুটির ক্ষতিপূরণ হয়। সর্বোপরি, সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের মাধ্যমে হিংসুকের হিংসা থেকে রক্ষা, বদ নজর থেকে নিরাপদ, বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবত থেকে দূরে থাকা যায়। তাই আমাদের সবার উচিত নিজের সামর্থ্যের মধ্যে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। আল্লাহতায়ালা আমাদের কোরআন-হাদিসের সঠিক বুঝ দান করুক। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads