মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
মানুষ নিজের ও পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করে। আরো ব্যয় করে বিলাসদ্রব্য, নেশারদ্রব্য সংগ্রহ করতে, সম্পদ পূঞ্জীভূত করতে, এমনকি নিজের বড়ত্ব জাহির করার উদ্দেশ্যও। কাজেই নিজ নিজ মেধা আর দক্ষতা নিয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত থাকে প্রত্যেকেই। এজন্য কেউ কৃষিকাজ করেন কিংবা করান, কেউ শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য করে। আর কেউবা কায়িক শ্রমের দ্বারাই এ চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। উপার্জন এবং উপার্জিত অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে অপরাপর মানুষের সঙ্গে ইসলামের অনুসারীদের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। একজন মুসলমান সবসময় লক্ষ্য রাখবেন তার উপার্জন যেনো শরীয়ত নিষিদ্ধ কোনো অবৈধ পন্থায় না হয়। এমনকি এ ক্ষেত্রে সন্দহের থেকেও দূরে থাকা। তিনি এও খেয়াল রাখবেন, তার উপার্জনে যেনো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সুদ প্রবেশ না করে। কেননা সুদকে আল্লাহতায়ালা হারাম ঘোষণা করেছেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ একটা অমানবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কেননা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, ঋণ তো অভাবীরা গ্রহণ করেন। আর যারা ঋণ দেন, তারা তো নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত অর্থটাই কেবল ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করেন। আপনার গ্রাম বা মহল্লার দরিদ্র চাষি, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা একজন শ্রমজীবীর কথা চিন্তা করে দেখুন, সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করলে তার অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কোনো ব্যক্তির নিজস্ব আয়ে বছরে দশ মাস ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। শেষ দুই মাসে সে সুদে টাকা দিয়ে সংসারের আয় বাড়ানোর কাজে বিনিয়োগ করলো। দ্বিতীয় বছর সব মিলিয়ে সে বারো মাস চলার মতো সামর্থ্য অর্জন করলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী বছরের ঋণ এবং সুদ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থে তার নয় মাস চললো। সুতরাং এ বছর তার তিন মাসের ব্যয় নির্বাহ করতে হবে নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে। এবার হিসেব করে দেখুন, সুদে টাকা ধার দিয়ে এ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটির পথে বসতে কবছর সময়ের প্রয়োজন হবে? এভাবেই সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার মারপ্যাঁচে পড়ে একটি পরিবার থেকে শুরু করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে হতদরিদ্র ও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
অর্থনীতি অনেক জটিল বিষয়। এ বিষয়ে বড় বড় পণ্ডিত যারা আছেন, তারা এর পক্ষে-বিপক্ষে জটিল জটিল সব যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে সক্ষম। এমনকি মহা মহাযুক্তি আর বড় বড় রেফারেন্স টেনে তারা সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার মহাত্ম্যও প্রমাণ করে ছাড়বেন, সন্দেহ নেই তাতে। আমার মতো স্বল্পবিদ্যা নিয়ে এসব বিতর্ক করাটাই একপ্রকার আহাম্মকি। তবে সবিনয়ে একটা কথা তো জিজ্ঞেস করতে পারি, আমাদের দেশের যেসব এনজিও সুদের বিনিময়ে অর্থ বিনিয়োগ করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নিরলস পরিশ্রম চালিয়ে আসছেন। বিগত দশ-বিশ বছরের একটা পরিসংখ্যান নিয়ে দেখুন তো, এতে ফুলে ফেঁপে উঠছে কারা? দরিদ্র ঋণগ্রহীতারা, নাকি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো। নিঃসন্দেহ দ্বিতীয় পক্ষই। কিন্তু কেনো?
আমার ধারণা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ব্যাপারটা ঠিক এমনটিই হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, এর পরিণাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভয়াবহ রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। একটি উন্নয়নশীল দেশকে সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষী ও পরনির্ভরশীল করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ঋণ দেওয়া হয় অনুৎপাদনশীল খাতে। ফলে সুদসহ ঋণের বোঝাটা হয়ে দরিদ্র জাতির ঘাড়ে চেপে বসে সিন্দবাবদের মতো। আর উৎপাদনশীল কোনো খাতে কিছু টাকা ঋণ বরাদ্দ হলেও এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হাজারো শর্ত। ফলে দাতার টাকার সিংহভাগ দাতার ঘরেই চলে যায়। মাঝখান থেকে সুদসহ কিস্তির টাকা যোগাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয় দরিদ্র দেশগুলোকে। দাতাগোষ্ঠীর কেষ্টবিষ্টুরা এবারে কিছুটা উদার হয়ে যান, এমনকি ঋণের অথবা সুদের খানিকটা তারা মাফও করে দেন। ফলে আমরা উন্নয়নশীলরা বগল বাজিয়ে বাহবা দেই, বাহ, এ না হলে কি আর দাতাগোষ্ঠী!
আমরা মুসলমানেরা তো পরলোকের কল্যাণ কামনা করি অর্থাৎ আখেরাতে বিনিময় পাওয়া যাবে, এ আশা নিয়ে দান খয়রাত করি। কিন্তু যাদের ধারণা আখেরাত বলতে কিছুই নাই, এ পার্থিব জীবনটাই সবকিছু। তারা নিঃস্বার্থে দান খয়রাত করতে যাবে কোন দুঃখে। আর মানবতা, সহানুভূতি, করুণা এগুলো তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিধানে শোভাবর্ধনের মতো শব্দ বৈ নয়। যা হোক, এরপর কিন্তু দাতাগোষ্ঠী আসল প্যাঁচটা কষতে শুরু করে। ওরা দরিদ্র দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করে। সোজাসুজি বলে দেয়, ‘অমুক অমুক শর্তগুলো মেনে নাও, নাইলে ঋণ পাবে না।’ এতে করে উন্নয়নশীল দেশের কর্ণধাররা পড়েন উভয় সংকটে। ওদের কথা না শুনলে ঋণ পাওয়া যাবে না, স্থবির হয়ে পড়বে উন্নয়ন প্রকল্প; আর শর্তগুলো, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধীই হয়ে থাকে। মেনে নিলে দেখা দেয় দেশব্যাপী গণ-অসন্তোষ আন্দোলন ও অশান্তি। সরকার পড়ে যায় উভয় সংকটে। এমনকি এ সংকটের গ্যাঁড়াকলে পড়ে কোনো কোনো দেশের সরকারের পতনও ঘটে যায়। এইটাই হলো, আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত একটা ব্যবস্থার বিষময় ফল। মানবতার কল্যাণে নিবেদিত দীন ইসলামে এর কোনো স্থান নেই। তাইতো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সুদ ও ব্যভিচার যখন কোনো দেশ বা শহরে ব্যাপক হয়ে দাঁড়াবে, তখন তাদের ওপর আল্লাহর আযাব অনিবার্য।’ (মুসতাদরাকে হাকিম-৩৪৪) সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা এবং এর প্রতিরোধ স্বরূপ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের সকলের ঈমানি দায়িত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
ahmadabdullah7860@gmail.com