• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯
ধনী-গরিব ও ইসলাম

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

ধনী-গরিব ও ইসলাম

  • প্রকাশিত ০২ জুন ২০২১

ওমর ফারুক বিন মুসলিমুদ্দীন

আমরা মানবজাতি সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে থাকি। এ প্রথা আদিকাল থেকেই চালু রয়েছে। একটি সমাজে অনেক রকমের মানুষ বসবাস করে। বিশেষত: কেউ ধনী, কেউ বা দরিদ্র। যারা ধনবান তাদের ধনসম্পদ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামতস্বরূপ। এ সম্পদকুল তাকে দেওয়া হয়েছে পরীক্ষামূলক। ধনীদের মাঝে যারা সম্পদকে পবিত্র রাখে, সম্পদের যথাযথ হক আদায় করে, তারা আল্লাহতায়ালার নিকট প্রশংসিত। আর যে আল্লাহর নিকটে প্রশংসিত; আল্লাহতায়ালা তাকে মানুষের নিকট সম্মানিত ও প্রশংসিত করে দেন। পক্ষান্তরে যারা সম্পদের পবিত্রতার ধার ধারে না ও তার হক আদায় করে না তারা সবাই স্থানেই নিন্দিত-ঘৃণিত। এসব লোক খুবই দুর্ভাগা। এদের অন্তর খুবই সংকীর্ণ। তারা স্বীয় সম্পদ নিজেরা ভোগ করতে পারে না। তাদের জীবন কাটে লাঞ্ছনা আর অপদস্ত হয়ে। সম্পদের ব্যপারে মনে কোনো স্বস্তিবোধ করে না। যত পায় তারা আরো তত চায়। সমাজে যারা নিম্নশ্রেণির লোক; তাদেরকে কোনো এক পয়সার মূল্যও তারা দেয় না। অহংকারে তাদের ভেতরটা ভরপুর।

আর যাদের ধনসম্পদ নেই, তারাও আল্লাহর পক্ষ থেকে অফুরন্ত নিয়ামতের অধিকারী। তাদেরকে ধন-সম্পদ না দিয়ে এ ধরণীতে পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রত্যেক সমাজেই কম-বেশি হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে। আমাদের দেশের গরিবরা দিনাতিপাত করে কীভাবে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ ধনীরা বুঝে না তাদের আত্মসম্মানবোধ। কিন্তু গরিবদের মাঝে এমন কতক ব্যক্তি আছে যারা নিজেদের আত্মসম্মানের ব্যাপারে খুব সতর্ক। তারা তাদের স্পর্ধা, স্পৃহাকে কখনো নষ্ট হতে দেয় না। একবেলা খেলে অন্যবেলা কী খাবে সে যোগাড় তাদের নেই। খুবই কষ্টে অগ্রে বাড়ে তাদের জীবনতরী। কিন্তু কোনোদিন মানুষের কাছে হাত বাড়ায় না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাগে না কারো কাছ থেকে। তারা বেঁচে থাকতে চায় অন্যের কাছে ভিক্ষা করা থেকে। চাওয়াতে লজ্জা-শরম তাদের ঘিরে বসে। ক্ষুধা নেই না কার? যার প্রাণ আছে তারই ক্ষুধা আছে। যে কোনো প্রাণীই ক্ষুধা লাগলে ঠিক থাকতে পারে না এটাই বাস্তবতা। মানুষ তো আরো এক কদম এগিয়ে। ক্ষুধানামক যন্ত্রণায়  কমসংখ্যক ধনীরাই পড়ে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কত বড় নিয়ামত তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভবপর নয়।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় কান, চোখ, হূদয় এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা আল-ইসরা, আয়াত- ৩৬) এতে মানুষের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও হূদয় সম্পর্কিত লাখো নিয়ামত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যেগুলো সে প্রতি মুহূর্তে ব্যবহার করে। সবাই কিয়ামতের দিন আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, সেগুলোর শোকর আদায় করেছে কী না? সেগুলোতে আল্লাহর হক যথাযথ আদায় করেছে কি না? নাকি পাপ কাজে ব্যয় করেছে? এতে সকল প্রকার নিয়ামত এসে যায়। একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে বের হলেন। পথে আবু বকর এবং উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমাও বের হলেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন বের হয়েছ? তারা বললেন, ক্ষুধার যন্ত্রণায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! আমিও সে কারণেই বের হয়েছি। তারপর তিনি বললেন, চল। তারা সবাই এক আনসারীর বাড়িতে আগমন করলেন। আনসারী লোকটির স্ত্রী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সঙ্গীদ্বয়কে দেখে যার-পর-নাই খুশি হয়ে শুভেচ্ছা ও স্বাগতম জানানোর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী জানালো যে, সে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে গেছে। ইত্যবসরে আনসারী লোকটি এসে তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজ কেউ আমার মতো মেহমান পাবে না। তারা বসলে তিনি তাদের জন্য এক কাঁদি খেজুর নিয়ে আসলেন যাতে কাঁচা-পাকা, আধাপাকা, ভালো-মন্দ সব ধরনের খেজুর ছিল। তারপর আনসারী লোকটি ছুরি নিয়ে দৌড়াল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সাবধান! দুধ দেয় এমন ছাগল জবাই করো না। আনসারী তাঁদের জন্য জবাই করলে তাঁরা ছাগলের গোশত খেলেন। খেজুর গ্রহণ করলেন ও পানি পান করলেন। তারপর যখন তৃপ্ত হলেন তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর ও ‘উমারকে বললেন, তোমরা কিয়ামতের দিন এ সমস্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমাদেরকে ক্ষুধা তোমাদের ঘর থেকে বের করল। তারপর তোমরা এমন নিয়ামত ভোগ করার পর ফিরে গেলে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং -২০৩৮)

আমাদের সমাজে বাস করে একশ্রেণির নীচুমনা ধনী। যাদের মনটা কালিমালেপিত। কলুষিত মেজাজের এ ধনীরা দেশ ও দশের শত্রু  বৈ কিছু নয়। এরা খাবার ডাস্টবিনে ফেলবে তবুও গরিবকে দেবে না। এমনকি পশু-পাখিকেও না। এদের ধন-দৌলত ভালো কাজে ব্যয় হয় না। ব্যয় হয় অসৎ কাজে। সমাজে যদি কোনো অসৎ কর্ম সাধনের জন্য তাদের নিকটে সহযোগিতা তালাশ করা হয়, তা দিতে রাজি হয়ে যায়। তারা থাকে অগ্রে। পক্ষান্তরে যদি কোনো ভালো কাজের জন্য তাদের আহ্বান জানানো হয়, তাতে কোনো সাড়া দেয় না এসব বদ লোক। তারা পিছু হটে যায়। মনে খুব সংকোচবোধ কাজ করে। এসব লোক সম্পদের জাকাত, যা গরিবের প্রাপ্য, তাও দিতে চায় না। এরা মানুষ হিসেবে যেমন নিকৃষ্ট তেমনি এদের সম্পদও নিকৃষ্ট। যদি এরা গরিবের দ্বারে জাকাত দিত, তবুও তা গরিবের প্রতি দয়া বলে গৃহীত হতো না। কারণ, এটা গরিবের হক। দয়া তো সেটা; সেচ্ছায় কারো বিপদাপদে নিঃস্বার্থে যে সহযোগিতা করা হয়। এ হক আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। মহান আল্লাহতায়ালা  কোরআন মাজীদে এর সবিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সাদকাহ হচ্ছে ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য। আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; তা বণ্টন করা যায় দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ  মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আত-তাওবাহ, আয়াত-৬০)

সম্পদ নামক নিয়ামতকে যেভাবে বিনষ্ট করা হচ্ছে তার হিসাবও কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আল্লাহর কাছে দিতে হবে। তার হিসাবখানা একবার মিলিয়ে দেখা উচিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামাত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহতায়ালার নিকট থেকে একে কদমও নড়বে না। ১. তার জীবনকাল সম্পর্কে; কীভাবে অতিবাহিত করেছে? ২. তার যৌবনকাল সম্পর্কে; কী কাজে তা বিনাশ করেছে? ৩. তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে; কোথা হতে তা উপার্জন করেছে? ৪. উপার্জিত ধন-সম্পদ কোন খাতে খরচ করেছে? ৫. সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল, তা মুতাবিক কী কী আমল করেছে?’ (তিরমিযি, হাদিস নং-২৪১৬)

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দিন।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫৫)

কিয়ামতের মাঠে কি যে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে, তা বর্ণনাতীত। সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে এবং তার মাতা, তার পিতা তার পত্নী ও তার সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের হবে এমন গুরুতর অবস্থা যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে। কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ একেবারেই উলঙ্গ হয়ে উঠবে। একথা শুনে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র স্ত্রীদের মধ্য থেকে কোনো একজন ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের লজ্জাস্থান কি সেদিন সবার সামনে খোলা থাকবে? জবাবে রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন, ‘সেদিন তাদের এমন গুরুতর অবস্থা হবে; যা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিজেতেই ব্যস্ত রাখবে।’ (সুরা আবাসা, আয়াত-৩৭) সেদিন অন্যের দিকে তাকাবার মতো হুঁশ ও চেতনা কারো থাকবে না। সুতরাং হে ভাবুক! ভেবে দেখ নিভৃতে। প্রস্তুতি কী তোমার?

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads