• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে মানবসেবার গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ১৫ জুন ২০২১

সাইফুল্লাহ ইবনে ইব্রাহিম

 

মানবসেবা ইসলামের একটি শাখা। ইসলামে মানবসেবার গুরুত্ব অপরিসীম। মানবসেবায় আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত আছে। ইসলাম মানুষকে একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা স্থাপনের কথা বলে। মানুষকে সেবা করার কথা বলে। মানুষের কষ্ট দূর করার কথা বলে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবী কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করবেন।’ (মুসলিম, আবু দাউদ) ইসলাম ধর্মে সেবার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুন্দর বিবৃত পন্থা আছে। এটিই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য। সর্বপ্রকার সেবার সর্বোত্তম আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের অধিকারী হলেন, আমাদের প্রাণ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রা.)। আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথের সঠিক ও সর্বোত্তম প্রয়োগকারী আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যে বৃদ্ধা তাঁকে গালিগালাজ করতো, তার বোঝা তিনি বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেন। যে বুড়ি তাঁর পথে কাঁটা দিত তার অসুস্থতায় তিনি সেবা করেন।

সাহাবি হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) যখন খলিফা ছিলেন, গমের বস্তা কাঁধে করে অভাবীর ঘরে পৌঁছে দেন। এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে বিরাজমান। পবিত্র কোরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে যতগুলো সৎকর্মের নির্দেশ রয়েছে তন্মধ্যে দুর্গত, বিপন্ন ও অভাবী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা, অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো অত্যধিক সাওয়াবের কাজ। এই ব্যয় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বলেই বিবেচিত হবে। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তাদের উপমা হচ্ছে একটি শষ্যবীজের ন্যায়, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে এবং প্রত্যেক শীষের একশ দানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে বহুগুনে দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত -২৬১) হজরত আবু হুরাইয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমার ধারণা তিনি আরো বলেন, ‘ওই সালাত আদায়ের ন্যায়, যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায়, যার সিয়ামে বিরত নেই।’ (সহিহ বুখারি)

মানবসেবায় ইসলামের উৎসাহ এতো বেশি যে, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলাও সাওয়াবের কাজ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ঈমানে ৭২ টি শাখা আছে। তন্মধ্যে একটি হলো রাস্তা থেকে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া।’ (মুসলিম শরিফ) মানুষের সেবার মাধ্যমে অতি সহজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা বলবেন ‘হে আদমসন্তান। আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক আপনি তো বিশ্বপালনকর্তা! কীভাবে আমি আপনার সেবা করব? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে তুমি তার কাছে আমাকে পেতে। হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম অথচ তুমি আমাকে আহার করাওনি।’ বান্দা বলবে, হে আমার রব, তুমি তো বিশ্বপালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাবো? তিনি বলবেন, তুমি কি জানো যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। অথচ তাকে তুমি খাদ্য দাওনি। তুমি কি জানো না যে, তাকে যদি তুমি আহার করাতে তবে আজ তা প্রাপ্ত হতে? হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম। অথচ তুমি আমাকে পানি দাওনি। বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন, তোমাকে কীভাবে পানি পান করাবো আমি? তিনি বলবেন, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে পান করাওনি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬৭২১)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা তার প্রতিবেশীকে উপোস রেখে খাবার গ্রহণ করে, সে আমার অনুসারী নয়।’ এই হাদিসটির মাধ্যমেও ইসলামের মানবসেবার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে আমাদের। তাই এসব বিধিবিধানের প্রতি আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহতায়ালা দুঃখী ও অভাবী মানুষের কষ্টকে অনুধাবনের জন্য সকল মুসলমান প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ওপর রোজাকে ফরজ করে দিয়েছেন। রমজানের একমাস সিয়াম পালন করা ধনী-গরিব সকলের ওপর ফরজ। জাকাত ফরজ করেছেন। সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করেছেন। ধনীরা তাদের মাল থেকে জাকাত দেবে এবং সাদকায়ে ফিতর আদায় করবে। এতে অভাবী-দুঃখী মানুষের অভাব দূর হবে। ইসলামে এমনভাবে জাকাত দেওয়ার নির্দেশ আছে, যাতে করে কোনো অসহায় ব্যক্তি নিজেই পরের বছর অন্যকে জাকাত দিতে পারে। নিয়মিত সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সমাজ হতে গরিব-দুঃখী মানুষের সংখ্যা কমে যায়। সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হয়।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। ইসলামের সঙ্গে চলতে হলে ইসলামের দেখানো প্রতিটি বিষয় মেনে চলতে হয়। তাই কেউ যদি মানুষের সেবা অথবা সাহায্য সহযোগিতার ব্যপারে উদাসীন থাকে তবে সে ক্ষেত্রে তার আমল পরিপূর্ণ হবে না। মানবসেবার জন্য পুকুর খনন, রাস্তা-ঘাট ও বাঁধ নিমার্ণসহ জনকল্যাণমূলক যে কোনো ভালো কাজ সেবার অন্তর্ভুক্ত এবং সাওয়াবের কাজও হয়। সেবা করা, গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো একটি উত্তম ইবাদত। যুগে যুগে ইসলামী মনীষীগণও মানবসেবায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বর্তমান সময়ের আলেম-উলামাগণ নিরন্তর মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিত রেখে এর প্রমাণ বহন করে চলেছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘প্রতিটি মুসলমানের জান-মাল, ইজ্জত ও শরীরের চামড়া যেভাবে আজকের এই মহান দিনে এই পবিত্র জিলহজ্জ মাসে এই হেরেম শরীফে ‘হারাম’ ও সুরক্ষিত, ঠিক তেমনিভাবে সব দিন সব মাস ও সর্বস্থানে হারাম ও সুরক্ষিত বলে গণ্য হবে। খবরদার! তোমরা আমার অবর্তমানে পুনরায় কাফেদের ন্যায় পরস্পর মারামারি, কাটাকাটিতে লিপ্ত হবে না’। (সহিহ বুখারি)

মানুষ সৃষ্টির সেরাজীব আশরাফুল মাখলুকাত। আমাদের আদিপিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও মা হজরত হাওয়া আলাইহিস সালাম হতে আমাদের মানবকুলের বংশ বিস্তৃত। সে হিসাবে আমরা একজন আরেকজনের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে জড়িত। প্রত্যেক মানুষ মানুষকে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে এই ভুবন সুন্দর করে তোলা সম্ভব। সেই সাথে উপার্জিত হবে পরপারের পাথেয়। ইসলাম এই শিক্ষা আমাদের দিয়েছে। ইসলামে মুসলমান ও বিধর্মী সবার সাথেই ভালো ব্যবহার এবং প্রয়োজনে তাদের সেবা ও উপকার করার কথা বলা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর সন্নিকটে, জান্নাতের কাছাকাছি এবং মানুষের নিকটবর্তী। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে এবং জাহান্নামের কাছাকাছি।’ (তিরমিযি)

আমাদের সমাজে অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে অনেক দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হচ্ছে, কিন্তু খোঁজ-খবর নেওয়ার কেউ নেই। এর কারণ হলো-আমাদের মাঝে এই ধরনের বিষয়গুলোর উদাসীনতা চলে এসেছে। মানবসেবার বিভিন্ন দিক আছে। যদি তা ছোট ক্ষেত্রেও হয়, তবু তার দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এমনকি প্রাণীকুলের জন্যও সেবা করার নির্দেশ ও শিক্ষা দেয় ইসলাম। আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে একে অপরের কল্যাণকামিতার জন্য। বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে থাকা ও সহযোগিতার হাতকে প্রসারিত করার জন্য।  কোরআনে আল্লাহতায়ালা মানবজাতির পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে-‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি; মানুষের কল্যাণে জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)

 

লেখক : ছড়াকার, প্রাবন্ধিক

saifullah6742@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads