• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮

ধর্ম

রাসুল (সা.)-এর আগমন ও উম্মতের করণীয়

  • প্রকাশিত ২২ জুন ২০২১

শাহ বিলিয়া জুলফিকার

আল্লাহতায়ালা এ দুনিয়াতে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। যার মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন হজরত আদম (আ.) আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর আগে সমস্ত নবী-রাসুলই ছিলেন এলাকা কিংবা জাতির জন্য প্রেরিত ও নির্ধারিত। কিন্তু তিনি সমগ্র মহাবিশ্বের নবী ও রাসুল। কোরআনে বিভিন্ন জায়গায় হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে। উম্মতকে দেওয়া হয়েছে অনেক দিকনির্দেশনা।

রাসুল (সা.)-এর আগমন : ইরশাদ হয়েছে- ‘আর স্মরণ করুন, যখন মারইয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিলেন, হে বনী ইসরাইল! নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসুল এবং আমার পূর্ব থেকে তোমাদের কাছে যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসুল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা। পরে তিনি যখন সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তাদের কাছে আসলেন তখন তারা বলতে লাগল, এটা তো স্পষ্ট জাদু।’ (সুরা আস-সফ, আয়াত-৬) এখানে ঈসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক সুসংবাদ প্রদত্ত সেই রাসুলের নাম বলা হয়েছে আহমদ। আমাদের প্রিয় শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম  মোহাম্মদ, আহমদ এবং আরো কয়েকটি নাম ছিল। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার কয়েকটি নাম রয়েছে, আমি  মোহাম্মাদ, আমি ‘আহমদ, আমি মাহী’ বা নিশ্চিহ্নকারী; যার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ কুফরি নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আর আমি ‘হাশির’ বা একত্রিতকারী; আমার কদমের কাছে সমস্ত মানুষ জমা হবে। আর আমি ‘আকিব’ বা পরিসমাপ্তিকারী।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৩৫৩২)

ওহী প্রেরণ : ইরশাদ হয়েছে ‘হে রাসুল! আমি তোমার কাছে ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ নাজিল করেছি, যেমনিভাবে নূহ ও তাঁর পরবর্তী নবী-রাসুলের কাছে ওহী নাজিল করেছি। যেমনিভাবে আমি নাজিল করেছিলাম ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর সন্তানদের কাছে এবং নাজিল করেছিলাম ঈসা, আইয়ুব, হারুন, ইউনূস ও সোলায়মানের কাছে। আর আমি দাউদকে দিয়েছিলাম আসমানি কিতাব জাবুর।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৬৩) এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, পূর্ববতী নবীগণের প্রতি যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাজিল হয়েছিল,  মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিও তেমনি আল্লাহতায়ালা ওহী নাজিল করেছেন। অতএব, পূর্ববর্তী নবীগণকে যারা মান্য করে, তারা  মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও মান্য করতে বাধ্য। আর যারা তাকে অস্বীকার করে তারা যেন অন্যসব নবীকে এবং তাদের প্রতি প্রেরিত ওহীকেও অস্বীকার করলো। ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু মানুষ মনে করে যে, মূসা (আ.)-এর পর আল্লাহ আর কোনো মানুষের ওপর অহী বা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ করেননি, এমনকি তারা  মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অহী বা প্রত্যাদেশকেও অস্বীকার করে। তারই প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ এই আয়াত অবতীর্ণ করে ওদের ধারণার খণ্ডন করেছেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত ও অহীকে প্রমাণ করেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)

রাসুল (সা)-কে অনুসরণের নির্দেশ : ইরশাদ হয়েছে-‘কেউ রাসুলের অনুসরণ করলে সে তো আল্লাহরই অনুসরণ করল। আর যারা আপনার অর্থাৎ রাসুলের অনুগত্য করল না, তারা জেনে রাখুক আমরা আপনাকে তাদের প্রহরী করিনি।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৮০) এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সকল লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু যে অস্বীকার করেছে (সে জান্নাতবাসী হতে পারবে না)। জিজ্ঞাসা করা হলো কে অস্বীকার করেছে, হে রাসুল! উত্তরে বললেন, যে আমার অনুসরণ করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল না, সে অস্বীকার করল।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৭২৮০) অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে আমার আনুগত্য করল সে অবশ্যই আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হলো সে আল্লাহর অবাধ্য হলো। অনুরূপভাবে যে ক্ষমতাসীনের আনুগত্য করল সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ক্ষমতাসীনের অবাধ্য হলো সে আমার নাফরমানি করলো। ইমাম বা শাসক তো ঢালস্বরূপ, যার  পেছনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা যায় এবং যার দ্বারা বাঁচা যায়। যদি ইমাম বা শাসক আল্লাহর তাকওয়ার নির্দেশ দেন এবং ইনসাফ করেন তা হলে সেটা তার জন্য সাওয়াবের কাজ হবে। আর যদি অন্য কিছু করেন তবে সেটা তার ওপরই বর্তাবে।’ (বুখারি, হাদিস নং- ২৯৫৭)

রাসুল (সা)-এর শ্রেষ্ঠত্ব : ইরশাদ হয়েছে, ‘তার কোনো শরিক নেই। আর আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম।’ ( সুরা আনআম, আয়াত-১৬৩) অর্থাৎ আমাকে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এরূপ ঘোষণা করার এবং আন্তরিকতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর আমি সর্বপ্রথম অনুগত মুসলিম। উদ্দেশ্য এই যে, এ উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম আমি। (আত-তাফসিরুস সহিহ) কেননা, প্রত্যেক উম্মতের সর্বপ্রথম মুসলিম স্বয়ং ওই নবীই হন, যার প্রতি ওহী নাজিল করা হয়। আর প্রত্যেক নবীর দীনই ছিল ইসলাম। (ইবন কাসির)

রাসুল (সা)-এর উম্মতের রূপ : ইরশাদ হয়েছে, ‘আর এভাবে আমরা তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থি জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির ওপর সাক্ষী হও এবং রাসুল তোমাদের ওওপর সাক্ষী হতে পারেন। আর আপনি এ যাবত যে কিবলা অনুসরণ করছিলেন সেটাকে আমরা এ উদ্দেশ্যে কেবলায় পরিণত করেছিলাম যাতে প্রকাশ করে দিতে পারি। কে রাসুলের অনুসরণ করে এবং কে পেছনে ফিরে যায়? আল্লাহ যাদেরকে হিদায়াত করেছেন তারা ছাড়া অন্যদের ওপর এটা নিশ্চিত কঠিন। আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৪৩) একাধিক হাদিসে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা নূহ আলাইহিস সালামকে ডেকে বলবেন, হে নূহ আপনি কি আমার বাণী লোকদের কাছে পৌঁছিয়েছেন? তিনি বলবেন, হ্যাঁ। তখন তার উম্মতকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদের কাছে কি তিনি কিছু পৌঁছিয়েছেন? তারা বলবে, আমাদের কাছে কোনো সাবধানকারী আসেনি। তখন আল্লাহ বলবেন, হে নূহ আপনার পক্ষে কে সাক্ষ্য দেবে? তিনি বলবেন,  মোহাম্মাদ ও তাঁর উম্মত। তখন তারা সাক্ষ্য দেবে যে, নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর বাণী লোকদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। আর রাসুল তখন তোমাদের সত্যতার ওপর সাক্ষ্য দেবেন। এটাই হলো আল্লাহর বাণী, ‘এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থি জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির ওপর সাক্ষী হও এবং রাসুল তোমাদের ওপর সাক্ষী হতে পারেন।’ (বুখারি, হাদিস নং-৪৪৮৭)

রাসুল (সা)-এর উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব : ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দেবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে। আর আহলে কিতাবগণ যদি ঈমান আনতো তবে তা ছিল তাদের জন্য ভালো। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুমিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসেক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০) হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সত্তরটি জাতিকে পূর্ণ করবে, তন্মধ্যে তোমরাই হলে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম এবং সবচেয়ে বেশি সম্মানিত।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-৩০০১) অপর হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতিদের কাতার হবে একশ বিশটি। তন্মধ্যে আশিটি কাতার হবে এই উম্মতের।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-২৫৪৬) অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, এ উম্মত হবে জান্নাতিদের অর্ধেক। (বুখারি, হাদিস নং-৬৫২৮, মুসলিম, হাদিস নং-২২১) আরেক হাদিসে এসেছে, এ উম্মত সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম, হাদিস নং-৮৫৫, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ১০৮৩)

উম্মতের করণীয় : ইরশাদ হয়েছে, ‘হে লোকসকল! অবশ্যই রাসুল তোমাদের রবের কাছ থেকে সত্য নিয়ে এসেছেন সুতরাং তোমরা ঈমান আন, এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে (১) আর যদি তোমরা কুফরি কর তবে আসমানসমূহ ও জমিনে যা আছে সব আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা,আয়াত-১৭০) অর্থাৎ একমাত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের মধ্যেই হেদায়াত সীমাবদ্ধ; তার অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণ করা চরম গোমরাহি। অতএব, ইয়াহুদিদের ধ্যান-ধারণা, ধর্ম-কর্ম ভ্রান্ত ও বাতিল। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ, তার জন্য যে আশা রাখে আল্লাহ ও শেষ দিনের এবং আল্লাহকে বেশি স্মরণ করে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-২১) এ আয়াতের উপসংহার বলে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করার এবং কাফের ও মুনাফেকদের অনুসরণ না করার পূর্ব বর্ণিত যে হুকুম তার তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, যে আল্লাহ যাবতীয় কর্মের পরিণতি ও ফলাফল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত, তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাময়। মানুষের যাবতীয় কল্যাণ ও মঙ্গল তাঁর পরিজ্ঞাত। (ইবন কাসির)

লেখক : শিক্ষার্থী, আলিম দ্বিতীয় বর্ষ, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টঙ্গী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads