• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮

ধর্ম

শুদ্ধ বন্ধু সুন্দর জীবন

  • প্রকাশিত ২৯ জুন ২০২১

মাসুম আলভী

 

বন্ধু শব্দটি ক্ষুদ্র হলেও মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বন্ধুর রঙ ব্যক্তি বিশেষ নানা রঙের ছোঁয়া লাগে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আনন্দ, বেদনা, ভালো লাগা, মন্দ লাগার সময় হাতে হাত রেখে চলা। বন্ধু হলো নৌকার মতো কখনো রঙিন পাল তুলে দিগ্বিদিক ছুটে চলে আবার স্রোতের বিপরীতে চলতে সাহস জোগায়। তবে বন্ধু নির্বাচনে কিঞ্চিৎ অবহেলা হলে নৌকা হারাবে ইহলকাল ও পরকাল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হায়! আমার দুর্ভোগ! আমার আফসোস! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ বাণী (কোরআন) পৌঁছার পর; আর শয়তান হলো মানুষের জন্যে মহাপ্রতারক।’ (সুরা আল-ফুরক্বান, আয়াত-২৮,২৯) বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার পূর্বে দেখা উচিত সত্যবাদী, দয়াবান, সৎচরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-১১৯)

কষ্টিপাথরের স্পর্শে লোহা একদিন সোনায় পরিণত হয়ে যায়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মানুষ তার বন্ধুস্বভাবী হয়, তাই তাকে লক্ষ করা উচিত, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (তিরমিযি) একজন আলোকিত মানুষের সংস্পর্শে এসে অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষটাও আলো ছড়ায়। আবার কলুষিত অন্তরের মানুষের সাহচার্যে অন্তরের প্রদীপ নিভে যায়। তাই বন্ধু হিসেবে দীনের আলোয় আলোকিত মানুষদের গ্রহণ করতে হবে। যাদের দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। নিজের সংশোধনের চেষ্টা করে ও বন্ধুদের উৎসাহিত করে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বন্ধুত্বের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সৎসঙ্গী এবং অসৎসঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে আতর বিক্রয়কারী এবং কামারের হাপরের ন্যায়। আতরওয়ালা তোমাকে নিরাশ করবে না; হয় তুমি তার কাছ থেকে ক্রয় করবে কিংবা তার কাছে সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাপর, হয় তোমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে, নচেৎ তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে আর না হলে দুর্গন্ধ পাবে।’ (সহিহ বুখারি)

পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি যদি কার বন্ধু হয় তবে তিনি পৃথিবীর কোনো কাজ করার জন্য চিন্তিত হতে হবে না। কেউ ক্ষমতাসীন নেতার স্নেহপুষ্ট হলে দেহ ফুলেফেঁপে বেলুন হয়ে উড়তে থাকেন। যারা মহান আল্লাহকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবেন, আল্লাহ তাদের অভয় দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনো ভয়ভীতি নেই, তাদের কোনো চিন্তাও নেই।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত-৬২) মনীষীদের ভাবনায় বন্ধু। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘বন্ধুরূপে কাউকে গ্রহণ করার আগে কয়েকটি গুণের দিকে লক্ষ রাখাতে হবে; নেককার ও পুণ্যবান, চরিত্রবান, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ।’ ইমাম জয়নুল আবেদিন তাঁর স্নেহধন্য পুত্র ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকিকে পাঁচ ধরনের মানুষের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন, মিথ্যাবাদী, পাপী, কৃপণ, বোকা ও যারা স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা করে। শেখ সাদী বলেন, ‘যে গোপনীয় কথা তুমি গোপন রাখতে চাও, তা তোমার বন্ধুকেও বলো না। কারণ, তোমার বন্ধুরও অনেক বন্ধু আছে। সেও তাদের নিকট তা প্রকাশ করতে পারে।’ এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন, ‘একটি বই একশটি বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান।’

বন্ধু যেন ঈমানবিধ্বংসী কার্যক্রমের জ্বালানিশক্তি না হয়। মুসলিম তরুণদের ধ্বংসের ফাঁদ পর্ণ ভিডিও আদান-প্রদানের মাধ্যম যেন বন্ধু না হয়। মাদকসেবন আড্ডায় যুক্ত করতে সহায়ক শক্তি যেন না হয়। ঈমানধ্বংসের চূড়ান্ত স্তর নারীর সংস্পর্শে আসতে অনুপ্রেরণা যেন না জোগায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে অবচেতন করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহাফ, আয়া-২৮) গেমসের আসরে মগ্নতায় ডুবে নামাজের প্রতি উদাসীন যেন না করে। কল্পনার ভেলায় ভাসিয়ে আত্মভোলা করে তোলে না যেন। ঈমানের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণের ব্যাপারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসল, আল্লাহর জন্য শত্রুতা করল, আল্লাহর জন্য দান করল এবং আল্লাহর জন্য দান থেকে বিরত থাকল, সে নিশ্চয়ই নিজের ঈমান পূর্ণ করল।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৬৮১) যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা বিপদগামী। কথায় আছে, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। শুভাশিস বন্ধু খুঁজে না পেলে একা থাকা উত্তম। সাহাবি আবু মুসা আল আশআরী ও আবু জার আল গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একাকী থাকার চেয়ে সৎসঙ্গীর সঙ্গে থাকা উত্তম। তবে অসৎসঙ্গীর চেয়ে একাকী থাকা উত্তম।’ (মুসান্নাফু ইবন আবী শায়বাহ, হাদিস নং-৩৫৯৬৫, আল মুসতাদরাক আলাস সাহিহায়ন, হাদিস নং-৫৪৬৬, শুআবুল ঈমান লিল বায়হাকী, হাদিস নং-৪৯৯৩)

জন্মবার্ষিকী, থার্টিফার্স্ট নাইট, রেস্তোরাঁয় নবাবী ট্রিট আর ঘোরাঘুরি। নেতার সভা সমাবেশ, অন্দরমহলে কুয়াশায় আছে নর্তকি। হামলা, মামলা, প্রশাসনিক জটিলতা! চিন্তা নাই বন্ধু আমি তো পাশেই আছি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন কোনো বন্ধু অপর বন্ধুর কোনোই কাজে আসবে না আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে  না।’ (সুরা আদ্-দুখান, আয়াত-৪১) অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর (সেদিন) অন্তরঙ্গ বন্ধু অন্তরঙ্গ বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করবে না।’ (সুরা আল-মাআরিজ) বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান বন্ধু দুনিয়ার সব কাজে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন। আর যারা আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করবে তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে।  প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ সেদিন তার আরশের ছায়া দান করবেন, যেদিন তার ওই ছায়া ছাড়া আর অন্য কোনো ছায়া থাকবে না; তন্মধ্যে সেই দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং এই বন্ধুত্বের ওপরেই তারা মিলিত হয় ও তারই ওপর চিরবিচ্ছিন্ন (পরলোকগত) হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৬০, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১০৩১)

একটি ভাত দেখে হাড়িভরা ভাতের অবস্থা বলা যায়।  বন্ধুও চেহারা দেখে চোখের-মনের ভাষা বুঝতে পারে। প্রিয় বন্ধুটি সকল কাজের সঙ্গী হয়। তাই মুমিনগণের বন্ধু কেমন হওয়া উচিত  আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের বন্ধু কেবলমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুল আর মুমিনগণ যারা সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহর কাছে অবনত হয়। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল আর মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তবে নিশ্চয় সেটি আল্লাহর দল আর তারাই বিজয়ী হবে।’ (সুরা আল-মায়িদাহ, আয়াত-৫৫,৫৬) আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন।  কোন কাজ মুক্তির বার্তা প্রদান করে। আর কোন কাজ স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে দূরত্ব তৈরি করবে। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-২৮) হাদিস শরিফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে সঙ্গী বা বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করবে না।’ (তিরমিযি) অন্তরের সাথে অন্তরের অদৃশ্য দৃঢ় বন্ধন হলো বন্ধু। আর সেই প্রকৃত বন্ধু যে আল্লাহভীরু। যে তোমাকে বিপদসীমা থেকে নিরাপদ ও চিরকালীন কল্যাণের পথে আহ্বান করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন বন্ধুগণ হবে একে অপরের শত্রু তবে মুত্তাকীরা (আল্লাহভীরুরা) ছাড়া।’ (সুরা আয-যুখরুফ, আয়াত-৬৭)

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads