• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ ভয়াবহ অপরাধ

  • প্রকাশিত ০৩ জুলাই ২০২১

আর. এম. আল আমীন

 

‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’-এরকম একটি স্লোগান বর্তমান বিশ্বে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বিশেষত আমাদের বাংলাদেশ তো এর মূর্তপ্রতীক। ধনী-গরিব, ছোট-বড়, উচ্চ-নিম্ন প্রত্যেকটি স্তরের মানুষ এই সুরে তাল মিলিয়ে চলছে। এ যেন এক মহা প্রতিযোগিতা। বিজয়ী হতেই হবে। আজ ভাই ভাইয়ের সম্পদ আত্মসাৎ করছে। নেতা আত্মসাৎ করছে জনগণের হক। লিডার হরন করছে কর্মীদের অধিকার। চতুর্দিকে দেদারসে আত্মসাতের ধুম পড়েছে। এই অপকর্মের অশুভ পরিণতি কি হতে পারে তা না জেনেই মানুষ ইহ ও পরকালীন জীবনকে ধ্বংস করার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আত্মসাৎ হলো কাউকে ধোঁকা দিয়ে তার সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া। হোক তা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ বা সরকারি সম্পদ। উভয় গোনাহ-ই সমান। আর তা থেকে ক্ষমা পেতে হলে ওই আত্মসাৎকৃত সম্পদের মালিকের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যদি সে তাকে ক্ষমা করে দেয়, তবেই সে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাবে। নয়তো নয়।

ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষেত্রে মালিক যেহেতু নির্দিষ্ট, সেহেতু তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া সহজ। কিন্তু সরকারি সম্পদের বেলায় এটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কেননা সরকারি সম্পদের মালিক নির্দিষ্ট কেউ নয়; বরং দেশের সব মানুষই এ সম্পদের মালিক। দেশের সব মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া কতটা কঠিন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সারা দেশের মানুষ যদি তাকে ক্ষমা না করে, তাহলে আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না। তার জন্য জাহান্নাম হবে অবধারিত।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খায়বার যুদ্ধে গমন করি। সে যুদ্ধে আমরা কোনো রৌপ্য বা স্বর্ণ লাভ করতে পারি নি। তবে বিভিন্ন মালামাল, খাদ্যদ্রব্য ও কাপড়-চোপড় লাভ করি। এরপর আমরা এক উপত্যকায় চলে যাই। সেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর একটা গোলাম ছিল। গোলামটি তাঁকে জুযাম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলেন। উপত্যকায় পৌঁছে আমরা যখন কাফেলা থেকে অবতরণ করলাম, তখন গোলামটি উটের ওপর অবস্থান করছিল। এমন সময় কোথা থেকে নিক্ষিপ্ত একটি তীর এসে তার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং তাতে তার মৃত্যু হয়ে যায়।

আমরা বলাবলি করতে লাগলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কী সৌভাগ্য লোকটির! সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করলো। তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কখনো না। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, নিশ্চয় সেই লম্বা চাদরটি আগুন হয়ে তার দেহ দগ্ধ করেছে। যেটি সে খায়বার দিবসে গণিমত বণ্টনের পূর্বে গোপনে তুলে নিয়েছিল। বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণ এ কথায় ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং যার কাছে একটা বা দুটি জুতার ফিতা ছিল, তাও এনে জমা দেন। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একটি জুতার ফিতা আগুনের অংশ, দুটি জুতার ফিতাও আগুনের অংশ।’  (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)

হজরত জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করে। পরে যখন সে মারা যায়, তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তার জানাজা পড়ান নি; বরং বললেন তোমাদের এ সঙ্গী আল্লাহর পথের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাতে একটি রেশমি বস্ত্র পেলাম, যার মূল্য হয়তো দুই দিরহাম হবে।’ (মুয়াত্তা, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজার) উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে সে প্রকৃত মুমিনই থাকেন না।

 

আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। (সুরা নিসা, আয়াত-২৯) উক্ত আয়াতে ‘বাতিল’ অর্থাৎ অন্যায়ভাবে এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবিগণ বলেন, শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ এবং না জায়েজ সবগুলো পন্থাকেই বাতিল বলা হয়। যেমন চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, বিশ্বাসঘাতকতা, ঘুষ, সুদ, জুয়া ইত্যাদি। সব প্রকার অন্যায় পন্থা এ বাতিল শব্দের অন্তর্ভুক্ত। (বাহিরে মুহিত) উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা শক্তভাবে আত্মসাৎ থেকে নিষেধ করেছেন। আর হাদিসেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আত্মসাৎ করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন। এতো কঠিন নিষেধাজ্ঞা আসার পরও আমরা আমাদের লোভকে অন্যের সম্পদ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারি না।

আমাদের অবস্থা হলো, আমরা যখন সরকারি চাকরি খুঁজি তখন এমন চাকরির সন্ধান করি যেখানে বেতন ছাড়াও অন্য কোনো উপায়ে টাকা আয় করতে পারবো। কারণ হালালে আমাদের চাহিদা মিটবে না। সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সরকার যে বাজেট দেয় তা দিয়ে নিশ্চিন্তে সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদন করা যায়। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর অবস্থা কি দাঁড়ায়? উন্নয়ন তো হলই না বরং যেই সেই। এর কারণ কি? ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে যাকে সরকার উন্নয়নমূলক কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে ব্যক্তি কিছু টাকা দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করে নিশ্চিন্তে দিনাতিপাত করছে। একবারও চিন্তা করে দেখেনি যে, সে কি করছে? কার হক মেরে খাচ্ছে? তার ক্ষমা সে আদৌও পাবে কি না।

সরকারি সম্পদ পুরো দেশবাসীর সম্পদ। তাই আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পেতে হলে আগে পুরো দেশবাসীর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। নতুবা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। কারণ এটা বান্দার হক। বান্দা মাফ করলেই তবে আল্লাহও মাফ করবেন। আল্লাহ আমাদের উত্তম বোধশক্তি দান করুন। আমিন।

 

লেখক : মুতাআল্লিম ও সদস্য বাংলাদেশ কওমি তরুণ লেখক ফোরাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads