• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

বিশ্বজয়ী পাঁচ মুসলিম বিজ্ঞানী

  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২১

মুহাম্মদ মিযান বিন রমজান

 

এই পৃথিবীর সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং নতুন নতুন আবিষ্কার প্রতিনিয়তই পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গোটা বিশ্বের অভূতপূর্ব বিকাশ ও আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। সময়ের ধারাবাহিকতায় এবং আবিষ্কারের নেশায় মুসলিম বিজ্ঞানীরা কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। তারা নিজ মেধা ও মননের দ্বারা বিশ্বদরবারে নিজেদেরকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এমনই পাঁচজন মুসলিম বিজ্ঞানীর আলোচনা এখানে করা হলো।

ইবনে সিনা, চিকিৎসাশাস্ত্রের গুরু : আবু আলী আল হুসাইন আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি ৯৮০ সালে বুখারায়  (উজবেকিস্তানে) জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে পবিত্র কোরআন হেফজ করেন। ষোল বছর বয়স থেকে ডাক্তারি নেশা জাগে তাঁর। তখন থেকে ডাক্তারি পড়তে থাকেন আর আবিষ্কার করতে থাকেন নতুন নতুন চিকিৎসার উপায়৷ ফলত মাত্র আঠারো  বছর বয়সে পুরোদমে ডাক্তার বনে যান। সতেরো বছর বয়সে ডাক্তারি পেশা গ্রহণ করেন। মরণ পর্যন্ত এই পেশায় অব্যাহত থাকেন।

তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। তাই মানুষের দোয়ায় অল্প সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর একশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর পাঁচ খণ্ডে রচিত ‘কানুন আল ফিত তীবকে’ মেডিকেল শাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়৷ গ্রন্থটি এতোই বহুমুখী যে, মধ্যযুগে ইউরোপে চিকিৎসার আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অষ্টাদশ শতকে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো মেডিকেল শিক্ষার্থীদের। এই মুসলিম বিজ্ঞানী ১০২৫ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন।

মুসা আল খাওয়ারিজমী, বীজগণিতের জনক : মুসলিম এই বিজ্ঞানী বীজগণিতের জনক হিসেবে পরিচিত থাকলেও ভূগোল, ত্রিকোনমিতিসহ বিভিন্ন দিকে রয়েছে তার অসামান্য অবদান। তিনি খোরাসান প্রদেশের খোয়ারিজমিতে (উজবেকিস্তানের জরাজম প্রদেশে) ৭৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পর মৃত্যু পর্যন্ত খলিফা মামুনের গ্রন্থগার ‘বাইতুল হিকমাহ’-এর  প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে থেকে বিজ্ঞান এবং গণিত গবেষণা  করতেন।

বীজগণিতে তার সবচেয়ে বড় অবদান ‘দি কম্পেন্ডিয়াস বুক অব ক্যালকুলেশন বাই কমপ্লেশন অ্যান্ড ব্যালিন্সিং’ অমর গ্রন্থটি। এর মূলকপি আজো অক্সফোর্ডে সংরক্ষিত। তার রচিত আরেক বই ‘আল জবর ওয়াল মুকাবিলা’ থেকে বীজগণিতের ইংরেজি নাম আল-জেবরা শব্দটির উৎপত্তি। তিনিই প্রথম পাটিগণিতে (০) শূন্যসহ অন্যান্য সংখ্যার ব্যবহার শুরু করেন। তার মাধ্যমে ইউরোপীয়রা শূন্যের ব্যবহার শিখে। অবশেষে তিনি ৭০ বছর বয়সে খলিফা মামুনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর (৮৫০ সালে) ইহকাল ত্যাগ করেন।

জাবের ইবনে হাইয়্যান, রসায়নের প্রাণপুরুষ : আবু মুসা জাবের ইবনে হাইয়্যান অমর কীর্তি রেখেছেন রসায়নে। রসায়নশাস্ত্রে সময়োপযোগী অনেক কিছু আবিষ্কার করেন এই মুসলিম বিজ্ঞানী। ইস্পাত তৈরি, লোহার মরীচিকা রোধ, অলংকারের মসৃণ খুদাই, কাপড় রং করার প্রণালি, চামড়ার টাংকি, বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থের  সংশ্লিস্টের  মতো বেশকিছু কার্যকরী বস্তুর আবিষ্কার তার হাতে। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘বুক অব স্টোনস’-এ  কৃত্তিম কাকড়া, সাপ, এমনকি রোবট (মানুষ) তৈরিরপ্রণালি উল্লেখ আছে বলেছেন ঐতিহাসিকরা৷ তিনি কুফাই একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে গবেষণা করেন।

তিনি ৭২১ সালে  খোরাসানে (আফগানিস্তানে) শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন ওষুধ প্রস্তুতকারক। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ বাবার থেকে গ্রহণ করেন। তারপর জাফর সাদিকের নিকট আলকেমি এবং চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যায়ন শেষে বাবার মতো ওষুধ প্রস্তুতের পেশা বেছে নেন। এরপর আস্তে ধীরে জ্ঞানবিজ্ঞান  গবেষণা ও আবিষ্কারে পদার্পণ করেন। ৮০৩ সালে বাদশা হারুনুর রশিদ নানা সন্দেহের জের ধরে তাকে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দেন। জীবন বাঁচাতে তিনি পলায়ন করেন কুফায়। অবশেষে ১০ বছর গৃহবন্দি থেকে ৮১৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

ইবনে আল হাইথাম, পদার্থবিজ্ঞানের কারিগর : আলোকবিজ্ঞানের কাণ্ডারি বিজ্ঞানী ইবনে আল হাইথাম। পশ্চিমারা তাকে আল হ্যাজেন নামে চিনে। তিনি ইরাকে বসরা শহরে ৯৬৫ সালে ধনাঢ্য পরিবারের  জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা শেষে বসরা শহরের গভর্নর নিযুক্ত হন। তখন বিজ্ঞান এবং অন্যান্য গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তিনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান পদ্ধতির প্রবক্তা। পদার্থবিজ্ঞানের ওপর রচিত সাত খণ্ডের গ্রন্থ ‘আল মানাজির তথা বুক অব অপটিকস’কে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সমকক্ষ ধরা হয়।

তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুতে পড়লে, সে বস্তুটি নজরে আসে। কিন্তু এই বিজ্ঞানী যুক্তি দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনিই আবিষ্কার করেন যে,  কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলে তবেই আমরা তা দেখতে পাই। তার লিখিত গ্রন্থ ‘বুক অব অপটিকস’ এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যবস্তু হয়ে আছে। তাঁর সম্মানে চাঁদের একটি জ্বালামুখের নাম করা হয়েছে আল হ্যাজেন। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ ইবনে আল হাইথামের আলোকবিজ্ঞান বিষয়ক কাজের এক হাজারতম বর্ষ উদযাপন করা হয়। এই মুসলিম নক্ষত্র ১০৪০ সালে অস্তমিত হয়।

প্রফেসর আব্দুস সালাম, নোবেলজয়ী মুসলীম বিজ্ঞানী : নোবেলজয়ী প্রথম মুসলিম বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম ১৯২৬ সালে ২৯ জানুয়ারি ভারতের পাঞ্জাবে শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বছর বয়স থেকেই কোরআন শেখা শুরু করেন মামার কাছে। ছোট থেকে সুন্নতি পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। স্কুলজীবনেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রেমে পড়েন। মেট্রিক পরীক্ষায় পুরো লাহোরে প্রথম হয়ে মানুষের চোখের মণি হয়ে উঠেন। এরপর থেকে ৭৫ টাকা বৃত্তি পেতেন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত  প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। তেইশ বছর বয়সে বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। তিনি আজীবন শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

তিনি পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ও দুর্বল নিউক্লিয়ার ফোর্সের একত্রীকরণ তত্ত্ব  বের করেন। যা আজো পদার্থবিদ্যায় ব্যবহূত হচ্ছে এবং এটাই ২০১২ সালের ‘হিগস বোসন’ কণার আবিষ্কারের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। পাকিস্তানের আসমাদি শহরে তাকে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য, তাকে অনেকে আহমদীয়া মনে করেন। তবে আজীবন তিনি নিজেকে মুসলিম দাবি করে গেছেন।  বিভিন্ন মিটিং ময়দানে কোরআন তেলাওয়াত করতেন তিনি।

 

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও গল্পকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads