• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

জিলহজ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

  • প্রকাশিত ১২ জুলাই ২০২১

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

 

জিলহজ মাস হিজরি সনের সর্বশেষ মাস। হিজরি সন হলো চন্দ্র সন। ইসলামে চন্দ্র সনের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কেননা সমস্ত আমলের সম্পর্ক চন্দ্রের সাথে তথা নামাজ,  রোজা, হজ, কুরবানি ইত্যাদি। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চাঁদের রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মনস্থ করলেন। এদিকে আল্লাহতায়ালা পূর্বেই এ বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবগত করলেন, ‘তারা আপনার নিকট নতুন চাঁদ সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি তাদের বলুন, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ ও হজের সময় ঠিক করার মাধ্যম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৯)

সন ও বছর হিসাবে মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তা হলো মুহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। এ চার মাসে যে কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, কলহবিবাদ নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা থেকে আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। আর এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং  তোমরা এর মাঝে নিজেদের ওপর অন্যায় করো না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-১০) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘মহান আল্লাহ যে দিন আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সে দিন থেকে কালচক্র এইভাবে আবর্তিত। বার মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং-১৯৪৭)

সম্মানিত এই চার মাসের মাঝে জিলহজ অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাস। কেননা মাসের নামের সাথেই জড়িয়ে আছে এই মাসের বিশেষ আমল হজ। হজ ইসলামের অন্যতম আমল। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের এক স্তম্ভ। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর জন্য হজ-উমরা পালন কর। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৬) হজের মাস হলো তিনটি-শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ এই তিন মাস হজের মাস হলেও হজের মৌলিক কাজ সম্পাদন করা হয় জিলহজের ৮ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত; এই ছয় দিনে। তাই হজের তিন মাস হওয়া সত্ত্বেও সাধারণত হজের মাস হিসাবে জিলহজ মাসই প্রসিদ্ধ। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, কয়েকটি নির্ধারিত মাস হজের মাস। এসব মাসে যে ব্যক্তি হজ পালনের নিয়ত করবে। তথা ইহরাম পরিধান করবে তার জন্য এ মাসগুলোতে স্ত্রী সহবাস করা, কোনো অশোভন কাজ করা এবং কলহবিবাদ করা জায়েজ নয়। আর তোমরা যেসব সৎকাজ করো আল্লাহ তা জানেন। তোমার সাথে (হজের) পাথেয় নিয়ে নাও। তবে নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়। হে বুদ্ধিমানগণ! অতএব আমাকে ভয় করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৭)

হজ সবার ওপর ফরজ নয়। যার আর্থিক ও শারীরিক সক্ষমতা আছে শুধুমাত্র তার ওপর হজ ফরজ। আর্থিক সক্ষমতা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হজের যাবতীয় খরচ বহন করার পাশাপাশি পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থের মালিক হওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তির বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে তার ওপর আল্লাহর জন্য ওই ঘরের হজ করা ফরজ। আর যে অস্বীকার করবে সে কাফের। আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুকেই পরোয়া করেন না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৯৭) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, ‘হে লোক সকল!  তোমাদের ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে। অতএব তোমরা হজ করো। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! হজ কি প্রতি বছর ফরজ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব থাকলেন। তাই সে তিনবার কথাটি বলল। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি হ্যাঁ বললে তো ওয়াজিব হয়ে যাবে। অথচ তোমরা পালন করতে সক্ষম হবে না। তিনি পুনরায় বললেন, তোমরা আমাকে ততটুকু কথার ওপর থাকতে দাও যতটুকু আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে বলি। কারণ তোমাদের পূর্বেকার  লোকেরা তাদের অধিক প্রশ্নের কারণে ধ্বংস হয়েছে। তাই আমি তোমাদের যখন কোনো কিছু করার নির্দেশ দিই তোমরা তা  যথাসাধ্য পালন করো এবং যখন তোমাদের কোনো কিছু করতে নিষেধ করি তখন তা পরিত্যাগ করো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৩১৪৮)

হজ-উমরা পালনকারীর জন্য রয়েছে অনেক সুসংবাদ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,  ‘তোমরা হজ-উমরা পরপর একত্রে আদায় করো। কেননা হজ-উমরা দারিদ্র্য ও গুনাহ দূর করে দেয় যেমনভাবে হাপরের আগুনে  লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর হয়। একটি কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়।’ (সুনান আত তিরমিযি, হাদিস নং-৮১০) অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হজ ও উমরাপালনকারী আল্লাহর মেহমান।’

হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যদি পালন না করে তার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর সতর্কবাণী। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কেউ যদি বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সক্ষমতা সত্ত্বেও হজ পালন না করে তাহলে সে ইহুদি হয়ে মরল নাকি নাসারা তথা খ্রিস্টান হয়ে মরল এ বিষয়ে (আল্লাহর) কোনো পরোয়া নেই। কেননা আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কিতাবে ইরশাদ করেন, ‘মানুষের মাঝে যার সে ঘরে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য।’ (সুনান আত তিরমিযি, হাদিস নং-৮১২)

জিলহজ মাসের ১ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত অধিক নফল ইবাদত করা। কেননা এই দশ দিনের নফল ইবাদত আল্লাহর নিকট অনেক প্রিয়। তাই অধিক নামাজ-রোজা, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ-তাহলীল ও ইস্তেগফার করা। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, অন্য যে কোনো দিনের অপেক্ষা জিলহজ মাসের দশ দিনের (নফল) ইবাদত আল্লাহতায়ালার নিকট অধিক প্রিয়। এই দশ দিনের প্রতি  রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য এবং প্রতিটি রাতের ইবাদত কদরের রাতের সমতুল্য। (সুনান আত-তিরমিযি, হাদিস নং-৭৫৮) জিলহজ মাসের নয় তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে তের তারিখ আসর নামাজ পর্যন্ত তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য ওয়াজিব। জামাতের সাথে নামাজ পড়ুক কিংবা একাকী পড়ুক। তাকবিরে তাশরিক হলো, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ্। আবু আব্দুর রহমান আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আরাফাতের দিন ফজর নামাযের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর বলতেন এবং ১৩ তারিখ আসরের পরও বলতেন। (আল মুসান্নাফ লি-ইবনে আবী শাইবা,  হাদিস নং-৫৬৭৭)

জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের বিশেষ আমল পশু কুরবানি করা। যার নিকট নিত্যপ্রয়োজন অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা এর সমপরিমাণ অর্থ থাকবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব। জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন। হে আল্লাহর রাসুল! কুরবানি কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, কুরবানি তোমাদের আদি পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাত। তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করল। এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন প্রতিটি পশমের বিনিময়ে নেকি রয়েছে । তারা (আশ্চর্য হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ভেড়া! (কারণ ভেড়ার পশম তো অধিক যা গণনা করা যায় না।) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও নেকি রয়েছে ।

(ইবনে মাজাহ : পৃষ্ঠা-২২৬)

যাদের কুরবানি করার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করবে না তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক কঠিন সতর্কবাণী করেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটও না আসে।’ (ইবনে মাজাহ : পৃষ্ঠা-২২৬)

 

লেখক : তরুণ আলেম ও ইসলামী লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads