• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ক্ষণস্থায়ী জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

  • প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০২১

রাশেদ নাইব

 

 

পৃথিবীতে বিচরণশীল প্রতিটি মানুষের একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে এবং থাকে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তার ধরন ভিন্ন হতে পারে। যেমন, একজন ছাত্রকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাহলে সে বলবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইন বিশেষজ্ঞ অথবা একজন আলেম কিংবা শিক্ষক। একজন শিক্ষা সমাপনী ব্যক্তিকে যদি একই প্রশ্ন করা হয় তাহলে সে বলবে ভালো একটা চাকরি অথবা ব্যবসা। তদ্রূপ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষ একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে।

 

কেউ রাজনীতিবিদ আবার কেউ জনসেবক হওয়া ইত্যাদি। অধিকাংশ মানুষের উদ্দেশ্য যখন দুনিয়াবি, তার মাঝে প্রকৃত মুমিন মুসলমানের জবাব হবে, দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে মহান মালিক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে অনন্ত সেই পরকালে মহা প্রলয়ের সন্ধিক্ষণে জান্নাত লাভ করা এবং অবর্ণনীয় মহাকঠিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

 

আখেরাতের দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মানুষের জন্য তার মূল উদ্দেশ্যে কী নির্ধারণ করা উচিত ছিল? এবং সর্বোচ্চ সফলতা প্রাপ্তি কোথায় নিহিত আছে। তা মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট করেছেন।

কারণ, সাধারণত সকলের ধ্যান-ধারণা ক্রিয়াকলাপ চিন্তা-ভাবনা সবকিছু অস্থায়ী পৃথিবীর অত্যন্ত স্বল্পকালীন আয়ুর ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে পরিচালিত জীবনের সংখ্যা অতি নগণ্য। যার প্রমাণ জীবনের উদ্দেশ্য জাগতিক ভিত্তিক। পরলৌকিক ভিত্তিক নয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের প্রত্যেকটি কার্যকলাপ, ধ্যান-ধারণা হওয়া উচিত চিরস্থায়ী জীবনকে সামনে রেখে। সে ক্ষেত্রে ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ, অসৎ কাজগুলি থেকে সরে থাকা বাঞ্ছনীয়, অথচ সে অবস্থান কতো দূরে? কিংবা বহু দূরে। ক্রমেই মেতে উঠেছি কোরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কার্যকলাপে।

 

অথচ মুমিনের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হবে সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য আছে জান্নাত। তারা আল্লাহ্‌র পথে যুদ্ধ করে, অতঃপর তারা মারে ও মরে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে এ সম্পর্কে তাদের হক ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে সওদা করেছ সে সওদার জন্য আনন্দিত হও। আর সেটাই তো মহাসাফল্য। (সূরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)

 

প্রতিটি মুমিন তার জীবনের লক্ষ্যকে একমাত্র দ্বীনের লক্ষ্য হিসেবেই নিবে। এবং আল্লাহর কাছে চিরস্থায়ী জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিবে। দ্বীন কে জমিনে স্তিমিত রাখার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা করবে। দ্বীনের জন্য তারা মারবে এবং দ্বীনের জন্যই মরবে। এর চেয়ে বড় সফলতা আর কি হতে পারে? অন্যত্রে আল্লাহতালা বলেন, প্রকৃত মুমিনরা বলবে আমি, একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিককদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরা আনআম, আয়াত ৭৯)

 

লক্ষ্য যেরূপ ভাবে আল্লাহমুখী হবে তদ্রূপ তার দুনিয়ার সকল কার্যকলাপেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশা থাকবে। যারা সত্যিকারের মুমিন তাদের হূদয়ে সদা আল্লাহর ভয় থাকবে এবং তারা দ্বীনের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে সর্বদা ‘ইন্না আকরা মাকুম ইন্দাল্লাহি আতক্বাকুম’ অর্থাৎ আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে হতে সর্বাধিক সম্মানিত সে ব্যক্তি, যিনি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করেন। (সূরা- হুজরাত, আয়াত-১৩) উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী সে ব্যক্তি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করবে,যার মাঝে পরকাল নিয়ে ভাবনা আছে। প্রত্যেক মুমিনলে যথাযথ সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

যে পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহভীতি আসবে তারা সে পথেই নিজেকে পরিচালিত করবে। সত্যিকার মুমিন হওয়ার পূর্বশর্ত হলো সত্যিকার অর্থে আল্লাহ ভীরু হওয়া। যার প্রমাণ কোরআনের শুরুতেই বিদ্যমান। যথা : আল্লাহ বলেছেন ‘জালিকাল কিতাবুল হুদাল্লিল মুত্তাকিন’ অর্থাৎ এ গ্রন্থে কোনো সন্দেহ বা ভ্রান্তি নেই। এটি সঠিক পথপ্রদর্শক আল্লাহ ভীরুদের জন্য। লক্ষ্য করুন, বলা হয়নি সঠিক পথপ্রদর্শক মুমিন-মুসলিমদের জন্য। অতএব যারা মুসিবত আসার পরেও দ্বীনের উপর ইসতেকামাত থেকে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে তারাই হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম।

মুমিনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে পবিত্র কোরআনের পাশাপাশি হাদিসেও অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যেমন হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করেন তিনটি জিনিস তোমাদের যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ লাভ করতে পারবে তা হল আল্লাহ ও তার রাসূল তার নিকট অন্য সকলের অপেক্ষায় অধিক প্রিয় হবেন, সে কাউকে ভালোবাসবে একমাত্র আল্লাহর জন্যই এবং সে কখনো কুফরির মধ্যে পুনরায় ফিরে যেতে রাজি হবে না, যেমন রাজি হবে না আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে। (বুখারি, বাবু হালাওয়াতিল ঈমানি, ১৫)

 

আমাদের নিকট যখন দুনিয়া অতি প্রিয় হয়ে গেছে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিবর্তনের ছাপ প্রকাশ পেয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে এক মহামারি আক্রমণ করেছে পৃথিবীকে।

ঈমানের পূর্ণতা নেই, মুসলামের পূর্ণতা বিলীন। ক্রমেই ধাবিত হচ্ছি পশ্চিমা কালচারের দিকে। সীমা লঙ্ঘন হওয়ার উপক্রম, সেই অবস্থা এক ভাইরাস এসে পালটে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর চিত্র।

ভুলে গেছি সৃষ্টিকর্তাকেও, দুনিয়ার লোভ লালসায় মত্ত হয়ে ভুলেই গেছি চিরস্থায়ী পরকালকে। অস্থায়ী সুখ-শান্তি ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছি।জশ সম্মান খ্যাতির পিছু ছুটছি প্রতিনিয়ত। ভুলেই গেছে আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো এক ফোটা নাপাক পানি থেকে। সাময়িক সময়ের জন্য এসব ভোগ, এর পরেই পারি জমাতে হবে চিরস্থায়ী গন্তব্যের পথে।

 

ক্ষণস্থায়ী জীবন ধারণ করে চিরস্থায়ী জগতের চিরস্থায়ী বা অনন্ত জীবনকে আমরা যেন ভুলে না যাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী পার্থিব জীবন কাফেরদের জন্য জান্নাত পক্ষান্তরে মুমিনদের জন্য জেলখানা অর্থাৎ কাফেরদের অবাধ বিচরণে শতভাগ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতা। পক্ষান্তরে মুমিনগণের জীবন, ধর্মীয় বিধানে আবর্তিত ও সীমিত যেমনি জেলখানায় কয়েদিদের জীবন নির্ধারিত পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ ও স্বাধীনতাহীন। জেলখানায় কয়েদি কখনো আরাম আয়েশে জীবন যাপন করতে পারে না কিন্তু আমার জীবনধারা দেখে এটা বোঝার উপায় নেই। এটা আমাদের জন্য জেলখানা।

 

কাজেই আমাদের উচিত হবে, ক্ষণস্থায়ী জীবনের আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করে, চিরস্থায়ী জীবের ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। তাহলেই কেবল ভয়ানক সেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা করা যাবে। মানুষ দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, তারা সমস্যায় জর্জরিত এই ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বহু বছর আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনের ছোট্ট একটি সূরা যেখানে আল্লাহতালা সুন্দর করে বর্ণনা দিয়েছেন। (১) শপথ সময়ের (২) নিশ্চয় (সকল) মানুষ অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত অর্থাৎ ব্যর্থ এবং জাহান্নামবাসী (৩) কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং যারা পরস্পরকে (কোরআন হাদিস অবলম্বনে) সত্যের উপদেশ দেয় এবং উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের (সকল পরিস্থিতিতে)। এই আয়াতের ব্যাখ্যাতে মুমিনের জীবনী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সাথে তাদের কী কী গুণাগুণ থাকবে তাও।

 

পরিশেষ, প্রত্যেক মুমিনের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনে কঠিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত হাসিল করা। আল্লাহতালা আমাদেরকে সেই তাওফিক দান

করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

 

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads