• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবক বাগেরহাটের লেবুয়াত শেখ

ছবি: বাংলাদেশের খবর

বাংলাদেশ

কৃষকের উদ্ভাবন

‘লেবুয়াত ধান’ একরে ফলে ১৩০ মণ

  • এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট
  • প্রকাশিত ০৮ মে ২০১৮

মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে আহারের মুখ। এই বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি আবাসন, তাদের নৈমিত্তিক চাহিদা পূরণের জন্য বাড়তি কলকারখানা কমাচ্ছে চাষাবাদের জমি। তবে আশার কথা, বর্তমানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে গেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের দেশের কৃষক-বিজ্ঞানীরা। নিজেরা মাঠে উৎপাদনের পাশাপাশি দারুণ কিছু উদ্ভাবনের কাজও করছেন। যেমন ঝিনাইদহের হরিপদ কাপালী। একেবারে গ্রামীণ আবহে কোনো ধরনের গবেষণাগার ছাড়াই অন্যের জমিতে কাজ করা হরিপদ কাপালী উদ্ভাবন করেন উচ্চফলনশীল এক জাতের ধান। হরিপদের আবিষ্কৃত সেই ধান ইতোমধ্যে সারা দেশের কৃষকদের কাছে বেশ পরিচিতি পেয়েছে, পেয়েছে জনপ্রিয়তাও।

হরিপদের পর এবার আরো একটি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাগেরহাটের লেবুয়াত শেখ। তবে কৃষিবিদরা বলছেন, লেবুয়াত শেখ উদ্ভাবিত এই ধান ফলন ও মানের দিকে হরিধানের চেয়েও এগিয়ে যেতে পারে।

জেলার ফকিরহাট উপজেলার চাকুলী গ্রামের কৃষক লেবুয়াতের আবাদি জমির পরিমাণ পাঁচ বিঘা বা ১৬৫ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশে তিনি প্রতিবছরই ধানের চাষ করেন। চাষাবাদের পাশাপাশি লেবুয়াতের আছে মাছের ব্যবসাও। কিন্তু লেবুয়াতের নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার স্বীকৃতি। তবে নতুন কিছু আবিষ্কারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না হলেও যে চলে তা আবার দেখালেন বাগেরহাটের কৃষক লেবুয়াত ও তার মা ফাতেমা বেগম।

বছর দুই আগে বাড়ির পাশের এক খণ্ড জমিতে আফতাব-০৫ জাতের ধানের চাষ করেন লেবুয়াত। সেই জমিতে পাকা ধান কাটার সময় দিনমজুরদের পানি পান করাতে যান লেবুয়াতের মা ফাতেমা বেগম। ধানক্ষেতে নেমেই ফাতেমা বেগমের চোখ আটকে যায় অপেক্ষাকৃত বড় একটি ধানের বাইল বা ছড়ায়। একটু এগিয়ে তিনি একই রকমের আরো দুটি ছড়া দেখে সেগুলো আলাদা করে বাড়ি নিয়ে আসেন। পরে সেই তিনটি ছড়ার ধান সংরক্ষণ করেন তিনি। আর লেবুয়াতকে বলেন পরের বছর এই ধানগুলোর আলাদা বীজতলা করার। লেবুয়াতও মায়ের কথামতো তাই করেন। তাতেই হয়েছে বাজিমাৎ। ২০১৭ সালে মাত্র ১ শতক জমিতে তিনি ওই ধান রোপণ করে সেখান থেকে আড়াই কেজি বীজ সংগ্রহ করেন। এ বছর তিনি ৭৫ শতক জমিতে সেই ধান রোপণ করেন তিনি। ইতোমধ্যে কিছু ধান কেটেছেন তিনি। এতে যেভাবে ফলন পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় ১০০ মণ ধান পাবেন তিনি।

সরেজমিন দেখা গেছে এই ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যেকোনো জাতের ধানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। আর প্রতিটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার।

লেবুয়াত শেখ তার এই প্রচেষ্টায় সব সময়ই পাশে পেয়েছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের। আর আবিষ্কারটি দারুণ সম্ভাবনাময় বলে কৃষি কর্মকর্তারাও নিজেদের উদ্যোগেই লেবুয়াত শেখকে দিয়েছেন নানান পরামর্শ। দুই বছর থেকে তিনিও হয়েছেন স্থানীয় আইপিএম ক্লাবের সদস্য।

ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোতাহার হোসেন জানান, স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে খবর পেয়ে তিনি নিজে সব সময় খেয়াল করেছেন। লেবুয়াতকে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি জানান, তাদের পরামর্শ অনুসারেই প্রতি গোছে একটি চারা রোপণ করেন লেবুয়াত। পরে সেই একটি চারা থেকেই ৮ থেকে ১০টি গাছের গোছা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ধানগাছ লম্বা গড়ে ৮৮ সেন্টিমিটার, পাতা চওড়া প্রায় দেড় ইঞ্চি। ফ্লাগলিপ (ছড়ার সঙ্গের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। এই জাতের গাছের কাণ্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখের মতো আর অনেক বেশি শক্ত। প্রতিটি ধানের ছড়া লম্বায় ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি।

স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সোলায়মান আলী জানান, প্রথমে তারা লেবুয়াতের ধানের ক্ষেতে গিয়ে ধানের নমুনা দেখে অবাক হয়ে যান। পরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাসহ প্রতিটি ছড়ার ধান গুনে দেখেন তারা।

মোতাহার হোসেন বাংলাদেশের খবরকে জানান, তারা গুনে দেখেছেন আফতাব-০৫ জাতের প্রতিটি ছড়ায় যেখানে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি করে ধান হয় সেখানে নতুন এই জাতের প্রতি ছড়ায় ধানবীজের সংখ্যা ১ হাজার থেকে ১২০০, যার ওজন ৩০ থেকে ৩৫ গ্রাম। এই হিসাবে একর প্রতি প্রায় ১৩০ মণ ধানের ফলন হবে।

এদিকে এই বিশেষ জাতের ধানের খবর ছড়িয়ে পড়ায় কৃষক লেবুয়াত শেখের বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন উৎসুক মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধানের খবর ছড়িয়ে পড়ায় অন্যান্য জেলা থেকেও কৃষকরা এই ধানের বীজ সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা করছেন। প্রতি কেজি ৪০০ টাকা দরে অনেকে সংগ্রহও করেছেন।

ওই গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, এই ধান নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। প্রতিটি ধানের বাইল অনেক বড়। দেশের অন্য কোনো স্থানে আছে বলে কারো কাছে শোনেননি তিনি। ভিন্ন জাতের এই ধান দেখতে ও বীজ সংগ্রহ করতে প্রতিদিনই অনেকে আসছেন তাদের গ্রামে। হাফিজ, লেবুয়াতের নামেই এই ধানের নামকরণের দাবি জানান।

একই গ্রামের কৃষাণী রীনা বেগমও জানান, সবার চোখ এখন লেবুয়াতের ধানের দিকে। এই ধানবীজ হিসেবে সংগ্রহ করতে প্রতিদিনই অনেক লোক আসছে। তিনি নিজেও প্রতিকেজি ৪০০ টাকা দরে ৪ কেজি ধানের বীজ কিনেছেন।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন এই জাতের ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিলে দেশে খাদ্যাভাব থাকবে না।

মোতাহার হোসেন জানান, এই ধানের নমুনা ইতোমধ্যে গাজীপুরের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) পাঠানো হয়েছে। বারির মহাপরিচালকও লেবুয়াতের ক্ষেতও পরিদর্শন করেছেন। তবে বারি থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

মোতাহার হোসেন বলেন, তারা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন লেবুয়াতের উদ্ভাবিত এই বিশেষ জাতের ধানের নানা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি অনেক বেশি লবণসহিষ্ণু জাত। গাছের কাণ্ডও অনেক বেশি মোটা ও শক্ত। ফলে ঝড়ে হেলে পড়ার কোনো ঝুঁকি নেই। এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়ায়ও পাতায় কোনো দাগ পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা এটি ‘ফাইন রাইস’ বা সরু জাতের ধান। গবেষণা করে এটি যদি আমাদের আবহাওয়া উপযোগী হয় তবে সারা দেশে এই জাত ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাগেরহাট জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, কৃষক পর্যায়ে উদ্ভাবিত এটি একটি নতুন জাতের ধান। এই ধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালনো হচ্ছে। বারির সাড়া পেলে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে এটি ছাড় করানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads