• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

উল্টোপথে চলছে বিআরটিএ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

দেশের সড়কে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে কয়েক হাজার নতুন যানবাহন। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না দক্ষ চালক সংখ্যা। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি সংস্থাগুলোর অনিয়ম ও উদাসীনতায় তৈরি হচ্ছে না প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ চালক।

বিআরটিএ ২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিবহন চালক, মালিক এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ফি ও করবাবদ ৩ হাজার ৭ কোটি টাকা আদায় করেছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী চালক সৃষ্টি, নিরাপদ সড়কের জন্য ত্রুটিমুক্ত যানবাহন এবং সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিআরটিএ’র অনিয়ম, দুর্বলতা এবং আইন প্রয়োগে ঘাটতির প্রভাব পড়ছে সড়কে।

যানবাহন তুলনায় বেশি সংখ্যক দক্ষ চালক তৈরির কথা থাকলেও সেদিকে কোনো পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বরং উল্টো কম সংখ্যক চালকের হাতে বেশি সংখ্যক ভারি যানবাহনের অনুমোদন দিচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটির শর্তের বেড়াজালে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যাও আশানুরূপ বাড়ছে না। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়ক বেপরোয়া যানবাহন ও অদক্ষ চালকদের দখলে। অদক্ষ চালক দ্বারা পরিচালিত এসব যানবাহনেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে প্রতিদিন লাখো মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানবাহন বাড়ানোর পাশাপাশি অধিক সংখ্যক দক্ষ চালক তৈরিতে বিআরটিএ’র গুরুত্ব দেয়া জরুরি। তাছাড়া অভিজ্ঞ চালক তৈরিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলসহ লাইসেন্সপ্রাপ্তি প্রক্রিয়া আরো সহজতর করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ চালক তৈরি হলেই সড়ক-মহাসড়কের নৈরাজ্য কমে যাবে বলে মনে করেন তারা। ১৯৮৭ সালে বিআরটিএ’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর সময় দেশে যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার। তখন চালক ছিলেন ১ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ গাড়ির চেয়ে চালকের সংখ্যা ১৫ হাজার বেশি ছিল। ধীরে ধীরে গাড়ি ও চালকের ব্যবধান বাড়তে থাকে। বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখের বেশি। কিন্তু চালকের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৭৫ হাজার। অর্থাৎ যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ কম। আর বেসরকারি পরিসংখ্যান হিসাবে সারাদেশে পরিবহন চালকের সংখ্যা ৭০ লাখ।

শ্রম আইন অনুযায়ী, একজন চালক একটানা সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা, সারা দিনে আট ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারবেন। চালকদের কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবহন মালিকদের। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ২০১৮ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে চালকদের কর্মঘণ্টা মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশনা দেন। সেটিও এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা বলছেন, কর্মঘণ্টা মানলে একটি ট্রাক বা বাসে তিনজন চালক দরকার। সংকটের কারণে গাড়ি চালাচ্ছেন অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকরা বা হেলপার। আবার চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে। এসব বিষয় তদারকি করে না বিআরটিএ।  ফলে চালকদের ওপর বাড়তি চাপেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়েছে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, ২০১০ সালের পর গত এক দশকে দেশে যানবাহনের সংখ্যা তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ২০১০ সালে দেশে যানবাহন ছিল ১৫ লাখের কাছাকাছি। তখন চালকের লাইসেন্স ছিল ১৪ লাখের মতো। গত ১০ বছরে যে হারে যানবাহন বেড়েছে, সেই হারে চালক তৈরি হয়নি। এমনকি বিপুলসংখ্যায় লাইসেন্স দেওয়ার মতো অবকাঠামোও বিআরটিএ’র নেই। লাইসেন্স পাওয়ার পদ্ধতি জটিল, দালালদের দৌরাত্ম্য এবং বিআরটিএ’র ঘুষ-দুর্নীতিও এ ক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন পরিবহনমালিকেরা। এ ছাড়া ২০১০ সালের আগে পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়া হতো সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তালিকা ধরে। অবশ্য এটি এখন বন্ধ আছে।

বিআরটিএ’র সর্বশেষ তথ্য (ডিসেম্বর ’২০) অনুযায়ী, দেশে এ মুহূর্তে বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলারসহ মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৮টি। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি। মোট নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে সারাদেশে মাঝারি ও ভারী পরিবহন রয়েছে ৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮০টি। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজার ৫২টি পরিবহন।  

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে বাংলাদেশে ট্রাক-বাস-মিনিবাসসহ ভারী যানবাহন চলছে ৪০ লাখের ওপরে। সমিতির দায়িত্বশীলদের বক্তব্য, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনিবন্ধিত গাড়ির সঠিক হিসাব দেশের কোনো সংস্থার কাছেই নেই। ৪০ লাখের বেশি যানবাহন রাস্তায় চালাতে প্রতিটি গাড়ির জন্য একাধিক চালক প্রয়োজন। সেই হিসাবে এসব যানবাহন চালাতে অন্তত ৮০ লাখ চালক প্রয়োজন। অপরদিকে বৈধ ২০ লাখ চালকের মধ্যে অনেকেই মারা গেছে। আবার অনেকে এখন আর গাড়ি চালান না। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরীতে ২০ লাখ নিবন্ধিত মোটরযানের বিপরীতে চালক রয়েছেন মাত্র ১৪ লাখ। একইভাবে লক্ষাধিক ভারী মোটরযানের বিপরীতে এগুলোর লাইসেন্সধারী চালক রয়েছেন মাত্র ২১ হাজার।

সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কে অনেক গাড়িই চালাচ্ছে হেলপাররা। যাদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অথচ আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে একজন পেশাদার চালকের বয়স হতে হয় কমপক্ষে ২০ বছর। যার কোনোটি না থাকা সত্ত্বেও গাড়িভর্তি যাত্রী নিয়ে চলছে এসব কিশোর চালক। এরা জানিয়েছে, পুলিশকে টাকা দিলেই বিনা বাধায় তারা সড়কে গাড়ি চালাতে পারে। দূরপাল্লার গাড়িগুলোর ১ শতাংশ বিআরটিসি নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি ৯৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি মালিকপক্ষ।

বিআরটিএ’র বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ড্রাইভিং লাইসেন্সের পূর্বশর্ত হলো লার্নার বা শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স। ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনকারীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণি পাস। অপেশাদারের জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ন্যূনতম ২০ বছর হতে হবে। পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরীক্ষার পর চালককে প্রথমে হালকা মোটরযানের (আড়াই হাজার কেজির কম ওজন) পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়। তিন বছর হালকা মোটরযান চালানোর পর একজন চালক মধ্যম শ্রেণির মোটরযান (আড়াই থেকে সাড়ে ৬ হাজার কেজি) চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেন। একইভাবে তিন বছর মধ্যম মোটরযান চালানোর পর চালককে ভারী মোটরযান (সাড়ে ৬ হাজার কেজির বেশি) চালানোর জন্য পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া হয়। বাস-ট্রাক চালাতে প্রয়োজন পড়ে ভারী শ্রেণির মোটরযান চালানোর লাইসেন্স।

১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি ছিল ৫০০ টাকা জরিমানা বা চার মাসের জেল কিংবা উভয় দণ্ড। অন্যদিকে সম্প্রতি কার্যকর হওয়া সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এ জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুণ। এক্ষেত্রে লাইসেন্সবিহীন চালককে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের জেল কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বাসভর্তি মানুষের জীবন একজন চালকের হাতে। কিন্তু তাঁর প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। পরিবহন মালিকরা আইনের কিছুই মানেন না। আর এগুলো দেখার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা বিআরটিএ’র সক্ষমতাই নেই। এ অবস্থায় দক্ষ চালক তৈরির প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু ফিটনেসবিহীন যান এবং লাইসেন্সবিহীন চালক রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, যা সড়কে শৃঙ্খলা আনা এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার পথে বড় বাধা।

তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ (নিবন্ধন বাতিল) ও অননুমোদিত বাস, লেগুনা, নসিমন-করিমন ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়ি সারা দেশে যাত্রী পরিবহন করছে। এসব চালকের কোনো লাইসেন্স নেই। সবধরনের যানবাহন নিবন্ধন দেওয়ার আগে বিআরটিএ-কে সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিককে দক্ষ চালক নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, চালক অদক্ষ বা ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হলে অথবা যানবাহন ত্রুটিপূর্ণ থাকলে দুর্ঘটনা বাড়বে, এটা বলার জন্য গবেষণার দরকার নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে বা প্রাণহানি কমবে, এমন আশা করা মোটেও ঠিক হবে না। তাই আগে পরিবহন নয়, আগে পর্যাপ্ত দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে।

চালক সংকট সম্পর্কে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, চালক সংকট সমাধানের জন্য আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছি। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।

বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, আমরা ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারা দেশে ভারী চালক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। চালক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও পরিচালনা করছি। পেশাদার লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে আমরা বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমও জোরদার করেছি। আগে যেখানে পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, সেখানে এখন রয়েছেন ১০ জন। আমরা যেভাবে পরিকল্পনা করেছি তাতে অবৈধ চালক সমস্যার সমাধান হবে আশা করি।

বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, নতুন সড়ক আইনের বিধিমালার খসড়ার ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া হচ্ছে। বিধি হয়ে গেলেই আইন প্রয়োগের জটিলতা মিটে যাবে। তাছাড়া চালক বাড়াতে তিন লাখ নতুন চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। একই সাথে বিআরটিএ লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads