• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন কর্মহীনরা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

যোগাযোগ

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন কর্মহীনরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১১ মে ২০২১

আয়-রোজগার বন্ধ। কর্মহীন হয়ে দীর্ঘদিন বেকার। করোনা অনেক মানুষের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। লকডাউনের ধাক্কায় বহু প্রতিষ্ঠান বিপর্যস্ত। কোনোটি এখনো বন্ধ, কোনোটি চালু হলেও হয়েছে অনেক ছোট পরিসরে। ফলে অনেক কর্মীকে চাকরি হারাতে হয়েছে ও হচ্ছে। ছোটখাটো ব্যবসা করতেন এমন অনেকে গত এক মাসের লোকসান সামলে উঠতে পারছেন না। এর মধ্যে রয়েছে ঈদের পরে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা। তাই ঈদ ছুটি পরে কাজের সুযোগ হবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। তাই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে নিরুপায় হয়ে ঢাকা ছাড়ছেন কর্মহীনরা। বর্তমানে করোনার কারণে লকডাউন থাকায় অর্থনৈতিক মন্দা চেপে বসেছে বাংলাদেশেসহ পুরো বিশ্বে। এ সময় কারও চাকরি চলে গেছে। কারও বেতন কমেছে। আবার কারও কারও কর্মক্ষেত্রই বন্ধ হয়ে গেছে। একদিকে আয়ের পথ বন্ধ, অন্যদিকে বেতন সংকুচিত হওয়ায় অনেকের পক্ষেই ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

মাস শেষে বাসা ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট-ডিশ বিলসহ নানা খরচে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে বহু মানুষের জীবন। শহরের ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন এসব কর্মহীন মানুষ। কেউ কেউ মালপত্র রেখেই যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গার্মেন্ট শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত বছর টানা ৬৬ দিন সবধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এমন কঠোর নির্দেশনায় এই দীর্ঘ সময়ে অচল হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতির চাকা। সে পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই এপ্রিল মাস থেকে চলছে টানা লকডাউন। ফলে দিনমজুর থেকে শুরু করে সচ্ছল চাকরিজীবীদের মাঝে এর প্রভাব পড়েছে। এ বুঝি লকডাউন  উঠে যাবে, সবকিছু স্বাভাবিক হবে সে আশায় থেকে যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে এতদিন চলছিল। কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বগতি শঙ্কিত করেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। তাই সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই দুর্ভোগের মধ্যে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ।   

গাবতলী বাস টার্মিনালে অপেক্ষমাণ বাস ওয়ার্কশপ কর্মচারী জাকির হোসেন বলেন, ঘরে খাবার নেই। বাসা ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছি আগেই। আশায় ছিলাম ঈদের আগে সব যানবাহন চালু হলে কাজ শুরু হবে। কিন্তু তা হলো না, মালিক কতদিন আমাদের বসিয়ে-বসিয়ে খাওয়াবে। অবস্থা যা দেখছি আগামী এক মাসেও বাস চালু হবে না। এ অবস্থায় সামনে আরো কষ্ট হবে। ভাগ্য বদলাতে ঢাকায় এসে এখন দুর্ভাগ্য নিয়ে ফিরতে হচ্ছে গ্রামে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাজের জন্য বগুড়া থেকে আবার ঢাকা আসবেন তিনি।

এদিকে শিমুলিয়া ফেরি ঘাটে জনস্রোত ঠেকাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক। মোড়ে মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি। তারপরও নানা উপায়ে ঘাটে জড়ো হন লাখো মানুষ। রোববার সকালে দুটি ফেরি ছেড়ে গেলেও, সারা দিন কোনো ফেরি যাতায়াত করেনি। তাতেও থেমে থাকেনি এসব মানুষের ঘাটে আসা। তাই বাধ্য হয়ে সোমবার কয়েকটি ফেরি চালু করে মানুষজনকে পার করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শিমুলিয়া ঘাটে কথা হয় ভোলার কাওছার পারভেজের সঙ্গে। রাজধানীর ওয়ারীতে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এপ্রিলে তার চাকরি চলে গেছে। কয়েকদিন আগে ভেঙে ভেঙে পরিবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ভেবেছিলেন লকডাউন উঠে গেলে মে মাসে নতুন কোনো কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। বাধ্য হয়ে শেষ পুঁজিটুকু দিয়ে দুই মাসের ঘরভাড়া মিটিয়ে ভোলার বোরহান উদ্দীনে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন তিনি। ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে পরবর্তী সময়ে বাড়ি ফেরার টাকাও তার কাছে থাকবে না। তাই দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে এর মধ্যেই তাকে বাড়ি যেতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ যাবৎ বাড়ি ফেরা মানুষের প্রায় সকলেই এমন অবস্থায় পৌঁছে ঢাকা ছাড়ছেন। দ্রুত সময় এসব কর্মহীন মানুষেরা কি আবার কাজে ফিরে যেতে পারবেন। এমন উদ্বোগ উৎকণ্ঠা নিয়ে ঈদ আনন্দটুকু কাটাতে হবে তাদের।

দেশের চাকরির বাজারে করোনা কতটা ক্ষতি করেছে তার হিসাব যদিও সরকারের কাছে নেই। কিন্তু বেসরকারিভাবে জরিপ করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলছে, গত বছরের লকডাউনের পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত করোনার প্রভাবে ৫ কোটির অধিক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলছে, এই সময়ে ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এখন এই কমে যাওয়া আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে টিকে থাকা নিঃসন্দেহে কঠিন হয়ে পড়বে।

সমাজকর্মী এম রুবায়েত হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তেমনি জীবিকা নিয়েও বিপদে পড়েছেন বিশেষত মধ্য ও নিম্নআয়ের অনেক মানুষ। সবকিছু সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হলেও একটি প্রতিষ্ঠানের সব কর্মী চাকরি ফিরে পাচ্ছেন না। অনেককে স্পষ্টভাবেই না করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেককে বলা হয়েছে কিছুদিন পর ডেকে নেওয়া হবে। এমন অবস্থায় আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে লোকজন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। সরকারের অনুদান বোধ করি তারা পাননি। আর পেলেও এই টাকায় তাদের চলা সম্ভব নয়। ফলে ঝুঁকি নিয়েও তারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। তাদের ধারণা হয়তো গ্রামে গেলে অন্তত না খেয়ে মারা যাবেন না। তবে এ অবস্থায়  গ্রামীন অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নিতে হবে তাদের। না হলে গ্রামেও তারা একই অবস্থার মুখে পড়বেন। এতেও সরকারের বা ব্যাংকের সাহায্য লাগবে। এদিকে শহরেও জরুরি কাজের জন্য লোক পাওয়া যাবে না।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, করোনার কারণে নব্য দরিদ্র গোষ্ঠীর সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই। নতুন মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল, তারা নব্য দরিদ্রে পরিণত হবে। এদের কেউই জানেন না পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে বা একটু স্বাভাবিক হলেও তারা আবারো ঢাকায় ফিরে আসতে পারবেন কিনা। তবে পরিস্থিতি সামলে দ্রুত তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া খুবই জরুরি। 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads