• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
ঢাকায় ফের বৃত্তাকার নৌপথ!

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

চার ধাপে ৯৪ কোটি টাকা জলে

ঢাকায় ফের বৃত্তাকার নৌপথ!

নতুন প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫,৪০০ কোটি টাকা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

সড়কের ওপর থেকে চাপ কমাতে ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় আবারো বৃত্তাকার নৌপথ তৈরির নতুন পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর আগে ঘটা করে কয়েক দফায় ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার নৌপথে যাত্রী পরিবহন শুরু করা হয়। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে কোনো উদ্যোগই বেশিদিন টেকেনি। এবার ঢাকার প্রধান পাঁচ নদী নিয়ে বৃত্তাকার নৌপথের নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে ব্যয় হবে ৬৩৬ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ৪ শ কোটি টাকা। একই পরিমাণ যাত্রী দেখিয়ে একাধিক প্রকল্পে কোনোটাই লাভজনক হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আগের উদ্যোগে পেশাদারিত্ব এবং জবাবদিহিতার অভাব দেখছেন। ফলে অবস্থা একই রকম থাকলে নতুন উদ্যোগও সফল না হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। অন্যদিকে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, আগের ওয়াটার বাসগুলো মানসম্পন্ন না হওয়ায় যাত্রীদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। এখন যাত্রীদের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার নতুন করে এই সেবা চালু করতে চাইছে।

২০০৪ সালে প্রথম ঢাকা থেকে গাবতলী পর্যন্ত একটি যাত্রীবাহী ওয়াটার ট্যাক্সি নামানো হয়েছিল। তারপর ২০১০ সালে ২৮ আগাস্ট দুটি ওয়াটার বাস নামানো হয়। কিন্তু যাত্রীর অভাব ও ওয়াটার বাসে ত্রুটির কারণে সেবাটি বন্ধ হয়ে যায়। এপর্যন্ত চারবার এ নৌপথটি উদ্বেধান করা হলেও অব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের ওয়াটার বাস আর যাত্রীর অভাবে এ পথটি কার্যকর না হওয়ায় এতে সরকারের ব্যয় করা ৯৪ কোটি টাকাই জলে গেছে।

দীর্ঘ সময় আলোচনার বাইরে থাকা বৃত্তাকার নৌপথ আবার চালু করতে পাঁচ প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এবং টঙ্গী খালের নাব্যতা বাড়িয়ে আবার নৌপথ চালু করতে চাইছে সরকার। ড্রেজিং, খনন, সীমানা পুনঃনির্ধারণ ও পানি শোধনের মাধ্যমে পরিবহন চালু করতে বিশ্বব্যাংক যে পরিকল্পনা দিয়েছে-তা বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২৯০ কোটি ডলার। আর এতে প্রথম দফায় ৩০ কোটি ডলার দেবে সংস্থাটি।

এছাড়া নদীতীর ধরে ৯১ কিলোমিটার ইনার সর্কুলার রোড নির্মাণে দুইশ কোটি ডলারের বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে সরকার। প্রায় একই পথে ৮১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ৮৩৭ কোটি ডলারের অর্থায়ন খুঁজছে সরকারের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)।

এক এলাইনমেন্ট ধরে তিন প্রকল্পে ১৩ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সড়কে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ বিবেচনায় বিকল্প পথের দরকার হলেও একই এলাইনমেন্টে একাধিক পথ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে কখনই লাভবান হবে না। তাছাড়া একাধিক প্রকল্প হাতে নেওয়ার কারণে কোনোটাই আলোর মুখ দেখছে না বলেও তারা মন্তব্য করেন।

রাজধানীর পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণে বিকল্প যাতায়াতব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিভিন্ন সংস্থার চলমান সাত প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে  আছে ১৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। এরই মধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুর থেকে ঢাকা-মাওয়া রোডের কালাকান্দি হয়ে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পর্যন্ত পৃথক একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে সওজ। ২ হাজার ৭০৫ মিলিয়ন ডলার প্রাথমিক ব্যয়ের প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা গবেষণা পরিচালনা করতে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্রও প্রকাশ করেছে পিপিপি অফিস।

বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত বৃত্তাকার নৌপথ আর সওজের প্রস্তাবিত এ আউটার সার্কুলার রোডের ব্যয় ধরলে ঢাকার বিকল্প সড়ক নির্মাণে বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার ৯৬ কোটি টাকা কোটি টাকা।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকায় সড়কের পরিমাণ কম থাকায় এখানে যানবাহনের গতি পায়ে হাঁটা গতির প্রায় কাছাকাছি নেমে এসেছে বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও বিশ্বব্যাংকের পৃথক গবেষণায় উঠে এসেছে। দুই সংস্থার হিসাবে ঢাকায় যানজটে বছরে লোকসান হয় ৩-৫ শতকোটি ডলার। আর সরকারের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার বা জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ।

এক্ষতি এড়াতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক। আর বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে এমনটা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজধানীর একবারেই নিকটবর্তী একই এলাইনমেন্ট বরাবর পরিবহন খাতের একাধিক প্রকল্প নেওয়ার যৌক্তিকতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, একই পথে সড়কে যাত্রী পাওয়া গেলে রেলে হয়ত যাত্রী পাওয়া যাবে না। আবার রেলে যাত্রী পাওয়া গেলে- সঙ্কটে থাকবে নৌপরিবহন। পরিবহন খাতে সরকারের প্রতিটি সংস্থাই প্রকল্প প্রণয়নে ব্যস্ত। একই পরিমাণ যাত্রী দেখিয়ে একাধিক প্রকল্প নিচ্ছে সংস্থাগুলো। এর ফলে কোনোটাই আর লাভজনক হবে না।

উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার দক্ষিণ থেকে উত্তরে যানজট এড়াতে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। প্রায় একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে, মদনপুর-দেবগ্রাম- ভুলতা-জয়দেবপুর চারলেন প্রকল্প। হাতে নেওয়া হচ্ছে হাতিরঝিল (রামপুরা ব্রিজ)-শেখেরজায়গা, আমুলিয়া, ডেমরা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। আর তিনটি প্রকল্পই পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টোলের ভিত্তিতে পরিবহন চলাচলের কারণে গরিব মানুষের তেমন কাজে লাগবে না এসব সড়ক। আর পরিবহনগুলো বিভিন্ন পথে ভাগ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদেরও তেমন লাভ হবে না।

ঢাকার চার পাশের পাঁচ নদীতে আবার নৌপরিবহন চালু করতে ৬৩৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় ধরে ঢাকা রিভারস ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন প্রজেক্ট  বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এতে সংস্থাটি ৩০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। অর্থ পাওয়া যাবে চীনভিত্তিক এআইআইবি থেকেও। সূত্র জানায়, এ প্রকল্পটি সরকারের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। বেশ কয়েকটি পর্যায়ে এর কাজ শেষ করতে ব্যয় হবে ২৯০০ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানে ঢাকা ও এর চারপাশের যানজট নিরসনে বাস্তবায়ন সক্ষমতার চাইতে বেশি প্রকল্প নেওয়ায় কোনোটাই সঠিক বাস্তবায়নের মুখ দেখছে না। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে, যানজট ও জনভোগান্তিও কমছে না। তাই বৃত্তাকার নৌপথ আসলেই সফল হবে কি-না তা নিয়ে আগে বিস্তর গবেষণা হওয়া উচিত, নইলে এ প্রকল্পও অলাভজনক হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads