• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

ট্রেনের টিকিট কিনতে ভোগান্তি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০২২

এবার নতুন পদ্ধতিতে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরুর প্রথম দিন ছিল গতকাল শনিবার। কিন্তু সার্ভার ডাউনের কারণে ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। টিকিটের জন্য ২৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টিকিট না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন অনেকে।

এদিকে অনলাইনে ঢুকতে না পেরে কাউন্টারে ভিড় করেন যাত্রীরা। ফলে শুক্রবার রাত থেকেই টিকিট পেতে উপচেপড়া ভিড় হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখানেও সার্ভার হ্যাং আর ধীরগতিতে নাজেহাল তারা। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না নিয়ে স্টেশনে গিয়েও বিপাকে পড়েন অনেক যাত্রী। সবমিলিয়ে টানা দুদিন অনলাইনে বিপর্যয় আর ভোগান্তির মধ্য দিয়ে গতকাল বিকাল ৪টায় শেষ হলো ঈদযাত্রায় রেলের ২৭ এপ্রিলের আগাম টিকিট বিক্রি।

এতো দুর্ভোগের পরও টিকিট বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম এর দাবি সবই ঠিকমতো চলছে।

অন্যদিকে ট্রেনের টিকিটের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হলেও ঝামেলা ছাড়াই মিলেছে বাস ও লঞ্চের টিকিট। বড় কোনো লাইন ছাড়াই বেশ সাবলীলভাবে বাসের আগাম টিকিট কিনতে পেরেছেন যাত্রীরা। তবে দুই-একদিনের মধ্যে টিকিট প্রত্যাশীর চাপ বাড়তে পারে বলছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। আর বাসের মতোই ঝামেলামুক্ত উপায়ে লঞ্চের আগাম টিকিট কিনতে পেরে স্বস্তিতে নৌপথের যাত্রীরা।

এবার যাত্রীদের এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন সনদের ফটোকপি কাউন্টারে প্রদর্শন করে ট্রেনের টিকিট কিনতে হচ্ছে। ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ নিশ্চিত করতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একজন যাত্রী একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কিনতে পারছেন। ঈদের অগ্রিম বিক্রিত টিকিট ফেরৎ নেওয়া হবে না। গতকাল শনিবার (২৩ এপ্রিল) থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি থেকে শুরু হয়েছে যা চলবে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টিকিট বিক্রি করা হবে। গতকাল ২৭ তারিখের ঈদযাত্রায় ৩৭টি আন্তঃনগর ট্রেনের মোট ২৬ হাজার ৭০০ টিকিট দেওয়া হয়েছে। এবারের ঈদে ফিরতি যাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে ১ মে। সেদিন দেওয়া হবে ৫ মের টিকিট।

গতকাল কমলাপুর, ফুলবাড়িয়া ও বিমানন্দর স্টেশন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় টিকিট প্রত্যাশীদের নানা ধরনের ভোগান্তি।  অনলাইনে টিকিট কিনতে না পারার অভিযোগ বেশির ভাগ টিকিট প্রত্যাশীর। অনেকেই সার্ভারে ঢুকতে পারছেন না। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টাকা কেটে নেওয়ার পরেও টিকিট দেয়নি- এমন অভিযোগ অনেকের।

কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিটের জন্য চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করছেন যাত্রীরা। চাহিদা অনুযায়ী টিকিট সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন রেলের কর্মীরা। অনলাইনে টিকিট না পাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতে অনেকেই রাত ১০টায় এসে লাইনে দাঁড়ান স্টেশনে। এই লাইন কাউন্টার থেকে স্টেশনের বাইরে পর্যন্ত চলে গেছে।

বেলা একটার দিকে কমলাপুরে টিকিট প্রত্যাশী রওশন হোসেন বলেন, রংপুরে যেতে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করতে শুক্রবার ইফতারের পর এখানে এসে সিরিয়াল দিয়েছি। কিন্তু সার্ভার জটিলতা ও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ১৮ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও তখনো তিনি টিকিট পাননি।

সমস্যার ব্যপারে তিনি জানান, অনলাইনে বহু চেষ্টা করেছি টিকিটের জন্য। কিন্ত সার্ভারে সমস্যা দেখায়। বিকাশ থেকে পেমেন্ট নেয় না। আজকে আর সার্ভারে ঢুকাই যাচ্ছে না।

মোহাম্মদ এনামুল হক বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, দুপুর ১২টার দিকে পাবনা চাটমোহর যাওয়ার টিকিট পেয়েছেন তিনি। এছাড়া, নারীদের জন্য একটি মাত্র কাউন্টার হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে।

নাজমা আক্তার গত বৃহস্প্রতিবার রাত ১০টায় লাইনে দাঁড়ান গাইবান্ধার টিকিটের জন্য। কিন্তু পরদিন দুপুর ১২টায় কাউন্টার থেকে জানানো হয়, গাইবান্ধার টিকিট শেষ হয়ে গেছে। এদিকে অনলাইনে তার পেমেন্ট নিলেও টিকিট পাননি।

নাজমা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এতো তাড়াতাড়ি টিকিট শেষ হয়ে গেছে মনে হয় না। এদিকে, অনলাইনে টিকিট-টাকা কোনোটাই পাচ্ছি না। আমাদের টিকিট না দিয়ে কাউন্টারের ভেতর থেকে অনেকেই টিকিট নিয়ে যাচ্ছে অন্যায়ভাবে। এতকিছুর পরও কালোবাজারিরা টিকিট নিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি ২৬ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাইনি।

টিকিট কাটার জন্য রাত দুইটায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন কুড়িগ্রামের শাহিন। বেলা ১২টার দিকে ফিরতে হলো খালি হাতে। টিকিট না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার দেখা মতে একশ জনকেও টিকিট দেওয়া হয়নি। এত টিকিট কোথায় গেল? এতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ হলো আমার।

বেলা ১২টার দিকেই শেষ হয়ে যায় উত্তরাঞ্চলের ট্রেনের টিকিট। রাতভর কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থেকেও ফিরেছেন খালি হাতে। টিকিট না পেয়ে চোখে মুখে ছিল হতাশার ছাপ। এরমধ্যে যারা টিকিট নামক সোনার হরিণ হাতে পেয়েছেন তাদের মুখে ছিল আনন্দের ছাপ। নিজের ভোগান্তির কথা তুলে ধরে একজন যাত্রী বলেন, ৪ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু এনআইডি কার্ডের ফটোকপি না থাকায় ওনারা টিকিট দিচ্ছেন না। আমার কাছে এনআইডি কার্ডের মূল কপি রয়েছে। কিন্তু মূল কপি দিয়ে তারা টিকিট দিচ্ছেন না। তবে দীর্ঘ অপেক্ষার পর যারা কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেয়ে উচ্ছ্বসিত আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, সেহরি খেয়ে এসেছি।  বেলা সাড়ে ১২টার দিকে টিকিট পেলাম, ভালো লাগছে।

এদিকে সার্ভার জটিলতার কারণে যাত্রীদের ভোগান্তির কথা খোদ কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজারও স্বীকার করলেন। সেই সঙ্গে কালোবাজারি প্রতিরোধে নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথাও জানান তিনি।

কমলাপুর রেলস্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে স্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার বলেন, আমরা জেনেছি অনলাইনে অনেকে টিকিট কাটতে পারছে না। এ বিষয়ে সহজডটকম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, সবাই যখন সকাল আটটায় টিকিটের জন্য একসঙ্গে সার্ভারে লগইন করে, তখন সার্ভারে সাইবার জ্যাম হয়। একারণে সকাল আটটা ১০ মিনিট নাগাদ টিকিট পেতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।

তিনি বলেন, সকালের দিকে একটি টিকিটের জন্য একসঙ্গে ৫০০-৭০০ মানুষ হিট (চেষ্টা করে) করে, তখন সাইবার জ্যাম হয়। এই সময়টাতে টিকিট পেতে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া তাদের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে অনেক টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তার মানে মানুষ টিকিট পাচ্ছেন।

ঢাকা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের মোট ১৬টি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে খুলনাগামী একটি স্পেশাল ট্রেন চলাচল করবে। আরেকটি ঢাকা থেকে জামালপুর। এই দুটি ট্রেন ২৯ তারিখ থেকে চলাচল করবে।

প্রতিবার ঈদ এলে স্টেশনে টিকিট কাটতে ভিড় হয়, কাউন্টারের সংখ্যা কেন বাড়ানো হয় না-এমন প্রশ্নের জবাবে স্টেশন ম্যানেজার বলেন, টিকিট কাউন্টারের সংখ্যা পর্যাপ্ত। একটা টিকিটের বিপরীতে কখনো ৭০০ মানুষের চাহিদা। আগে কমলাপুর থেকে সব ট্রেনের টিকিট বিক্রি হতো। এবার সেটি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার অন্য আরো চারটি স্থান থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। তবু স্টেশনে মানুষের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

স্টেশনে মানুষের চাপের ব্যাখ্যায় মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার বলেন, কোনো কোনো পথের ট্রেনে টিকিট ৭০০। এর মধ্যে কাউন্টারে ৩৫০ টিকিট। কিন্তু মানুষ টিকিটের সারিতে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার। এত চাপ নেওয়া কঠিন। যেহেতু আসন সংখ্যা সীমিত, তাই সীমিত সংখ্যক যাত্রীকেই টিকিট দিতে পারব।

কাউন্টারে টিকিট কেনায় ধীরগতি প্রসঙ্গে স্টেশন ম্যানেজার বলেন, মানুষ টিকিট পাওয়ার জন্য ভোরে বা রাতে এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রীর এনআইডি নম্বর নেওয়া হচ্ছে। টিকিট কাটতে গিয়ে একজন যাত্রীর জন্য অনেক অপশন থাকায় সময় নিতে হচ্ছে, যার ফলে দেরি হচ্ছে।

যাত্রার সময় যাত্রীর জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্টেশনের কর্মকর্তারা, ট্রেনের টিকিট এক্সামিনাররা এটা নিশ্চিত করবেন। যে এনআইডি দিয়ে টিকিট কেনা হয়েছে, যাত্রীর সঙ্গে সে এনআইডি থাকতে হবে। ভ্রমণের সময় যাত্রীকে এনআইডির কপি রাখতে হবে।

তিনি আরো জানান, কমলাপুর স্টেশনে পশ্চিমাঞ্চল‌ ও খুলনাগামী ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী আন্তনগর ট্রেনের টিকিট এবং তেজগাঁও স্টেশনে ময়মনসিংহ, জামালপুরগামী, দেওয়ানগঞ্জ স্পেশালসহ ওই অঞ্চলের সব আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে মোহনগঞ্জ ও হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের এবং ফুলবাড়িয়া পুরোনো রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেট ও কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।  কাউন্টার থেকে টিকিট যেন কালোবাজারিদের হাতে না যায় সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। র্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি এখানে কাজ করছে। ফলে কাউন্টারের বাইরে অন্য কোনো উপায়ে টিকিট পাওয়ার সুযোগ নেই। 

এদিকে, বিক্রি শুরুর প্রথম ঘণ্টায় অনলাইনে ৫০ হাজারের বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছে।

গতকাল দুপুরে টিকিট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজের পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজার ফারহাত আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

সহজ জানায়, রেলওয়ে টিকিটিংয়ের ইতিহাসে এ প্রথম গ্রাহকরা সফলতার সঙ্গে ঈদের টিকিট কাটছে। এর পুরো কৃতিত্ব সহজের। ঈদের টিকিট বেচা-কেনার প্রথম দিনেই প্রতি মিনিটে অনলাইনে প্রায় ৫ লাখ হিট বা ট্রাফিক সফলভাবে পরিচালনা করতে পেরেছে সহজ।

একই সঙ্গে দেশব্যাপী ৭৭টি স্টেশনে কাউন্টারে সফলতার সঙ্গে চলছে সহজ-এর টিকিটিং সিস্টেম। সহজ আরো জানায়, ২৩ এপ্রিল সকাল ৮টা থেকে ২৭ এপ্রিলের ঈদের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। বিক্রি শুরুর প্রথম ঘণ্টায় প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে যাত্রীরা সফলতার সঙ্গে টিকিট কাটতে পারছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads