• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
বিপুল বিনিয়োগ তবুও দুর্ভোগ

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

বিপুল বিনিয়োগ তবুও দুর্ভোগ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৭ মে ২০২২

দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও সড়ক-মহাসড়কে স্বস্তি মিলছে না। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ডিজাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী, নির্মাণের পর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যদিয়ে একটি সড়ক ২০ বছর পর্যন্ত টেকসই হওয়ার কথা। কিন্তু বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত সড়ক-মহাসড়কগুলো টেকসই হচ্ছে না। এরমধ্যে আগামী বাজেট থেকেই দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বার্ষিক বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে উন্নয়নের অংশ হিসাবে অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুদিন পরেই সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। রাস্তা তৈরির তহবিল আছে, মেরামতের তহবিল নেই। তাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে সরকারি যে বরাদ্দ থাকে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই বিপুল অর্থ ব্যয় করেও দেশের সড়ক মহসড়কে শৃঙ্খলা বা স্বস্তি ফেরেনি। তাই নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের তহবিল গঠন করে সড়ক মহসড়ক রক্ষাণাবেক্ষণের পরামর্শ তাদের।

এদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সরকার পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বার্ষিক বরাদ্দ ১৪ শতাংশ করে বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। এই খাতে মোট ব্যয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৬১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৮৭ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন টাকা এবং চলতি অর্থবছর ২০২১-২২ এ ৭২০ দশমিক ২৮ বিলিয়ন টাকা ধরা হয়েছে। এর আগে এই খাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪৫০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৩৭ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন টাকা। একটি সুসংগঠিত পরিবহন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করে কাঁচামাল এবং পণ্যের সুষম উৎপাদন ও বণ্টন নিশ্চিত করে এ পরিকল্পনা করেছে সরকার।

গত এক দশকে বাংলাদেশও সড়ক পরিবহন খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। চার-ছয় লেনের নতুন সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে-সেতু-ফ্লাইওভারসহ জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগ হয়েছে নগর-মহানগরের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নেও। চলমান রয়েছে পদ্মা সেতুসহ একাধিক মেগা প্রকল্প। যদিও এক দশকের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ সড়কে নিরাপত্তা বা স্বস্তি কোনোটাই নিশ্চিত করতে পারেনি। উল্টো এ সময়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। বেড়েছে যানজটও। এতে একদিকে বিলম্বিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভ্রমণ, অন্যদিকে ক্ষত তৈরি হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে। পরিবহন খাতের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায়ও প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছে মানুষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের ছয়টি সংস্থা, অধিদপ্তর ও করপোরেশনের মাধ্যমে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা হয়। এ সংস্থাগুলির মাধ্যমে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১১-১২ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। বিনিয়োগ হওয়া অনেক অবকাঠামো যেমন এরই মধ্যে চালু হয়েছে, তেমনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নির্মাণকাজ এখনো চলমান বা শেষের পথে। এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও দেশের সড়ক চলাচলকে নিরাপদ করে তুলতে পারেনি; বরং এক দশকেরও কম এ সময়ের মধ্যে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণে।

এদিকে বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৪৪ জনের, যেখানে ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল আড়াই হাজার। অন্যদিকে চার-ছয় লেনের সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারের মতো বৃহৎ অবকাঠামোগুলোও সড়ক যাতায়াতে মানুষের ভোগান্তি কমাতে পারেনি। বিলম্বিত করছে পণ্য পরিবহন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত যাতায়াতের সময় কমিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী দুর্ভোগ রয়ে গেছে আগের মতোই। এক দশক আগে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে যাতায়াতে সময় লাগত ৬-৭ ঘণ্টা। চার লেনের সড়ক হওয়ার পরও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। গাড়ির চাপ বাড়লে এখন ৬-৭ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায় মহাসড়কটি পাড়ি দিতে। একই অবস্থা চার লেন হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেরও। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা কোনো সড়কেই স্বস্তিতে চলতে পারছে না মানুষ।

অভিযোগ রয়েছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ডিজাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী নির্মাণ ও নির্মাণের পর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। নিম্নমানের নির্মাণকাজ ও উপকরণ ব্যবহার, নকশা ও পরিকল্পনার ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে এক-দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হচ্ছে সড়ক। চলাচলের জন্য হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ। ভাঙাচোরা সড়কে যাতায়াতে যেমন বাড়তি সময় লাগছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। আবার সড়কের পাশে গড়ে ওঠা হাটবাজারও দুর্ঘটনা-যানজটের কারণ হচ্ছে। সওজ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখনো ভাঙাচোরা দশায় রয়েছে দেশের ৩ হাজার ৬৪৭ কিলোমিটার সড়ক। যেসব সড়ক ভালো আছে, সেগুলোর বিভিন্ন নকশা ও পরিকল্পনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি বাড়িয়ে দিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. শামসুল হক, উন্নয়নের একটা অংশ হলো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ। আমাদের দেশে উন্নয়নের অংশ হিসাবে অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুদিন পরেই সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ করতে যদি দেরী হয়ে যায়, তাহলে ভোগান্তির পাশাপাশি সেটা ঠিক করতে খরচ অনেক বেশি হয়ে যায়। আমাদের দেশে এটা একটা সমস্যা, কারণ অনেক সড়ক ঠিক সময়ে মেরামত করা যায় না। হয়তো রাস্তা তৈরির তহবিল আছে, মেরামতের তহবিল নেই। ফলে এজন্য একটি তহবিল অনেক আগে থেকেই দরকার ছিল।

তিনি বলেন, যদিও ২০০২ সালে প্রথম এই ধরনের তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কোন মন্ত্রণালয়ের আওতায় বোর্ড থাকবে, এ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। ২০১৩ সালে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড আইন গঠন করা হয়। সেই আইনের আওতায় এখন বিধি তৈরি করা হচ্ছে। তাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে সরকারি যে বরাদ্দ থাকে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের তহবিল থাকলে তা সবার জন্যই ভালো।

সড়ক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, সড়ক খাতে দুর্বল অবকাঠামোর কারণে পণ্য ও মানুষের চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। যানজটে নাকাল হচ্ছে মানুষ। আর প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের মিছিল। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে লাগছে অতিরিক্ত সময়। তাতে বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ব্যয়। যার খেসারত দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

তাছাড়া একটি দেশের উন্নয়নের লাইফলাইন হলো মহাসড়ক। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে হারে প্রবদ্ধি হচ্ছে, টেকসই মহাসড়ক গড়ে তুলতে পারলে প্রবদ্ধির হার আরো বেশি হতে পারতো। বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের প্রায় পুরোটাই সড়কপথে হচ্ছে। কিন্তু দুর্বল সড়কের কারণে ওসব পণ্য বন্দর থেকে ভোক্তা পর্যায়ে কিংবা উৎপাদক থেকে বন্দরে পৌঁছাতে সময় বেশি লাগছে। ফলে তাতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে।

সড়ক নিরাপত্তা ও যাতায়াতে স্বস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা সওজ অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী মনির হোসেন পাঠান। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা শুধু একটি নির্দিষ্ট সংস্থার বিষয় নয়। এর সঙ্গে অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। কোনো সংস্থা সড়ক নির্মাণ করে, কোনো সংস্থা সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে, আবার কোনো সংস্থা সড়ক ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকে। সবকটি সংস্থা যদি তাদের দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে অবশ্যই সড়ক অবকাঠামোকে নিরাপদ করে গড়ে তোলা সম্ভব। সওজ অধিদপ্তর নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথভাবেই পালন করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads