• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
আটক হয় একটি, ঢোকে ১০টি

ছবি : সংগৃহীত

অপরাধ

ইয়াবার আগ্রাসন থেমে নেই

আটক হয় একটি, ঢোকে ১০টি

# বন্দুকযুদ্ধে মরছে চুনোপুঁটিরা # গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে # সীমান্তরক্ষীদের ওপরেই নজরদারি ইউনিট গড়ার পরামর্শ

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০১৯

জিরো টলারেন্স ঘোষণা, বিশেষ অভিযান, চিরুনি অভিযান-কোনো কিছুতেই মাদকের আগ্রাসন রোধ করা যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবারও রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে মাদক সেবন ও বিক্রির অভিযোগে ৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ (এএপি)। অন্যদিকে কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদের তীরে নৌকা থেকে ৭ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছেন বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সদস্যরা। প্রতিদিন নগরীতে অভিযান চলছে, কমবেশি মাদক উদ্ধার হচ্ছে। মাদক সেবন ও বহনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে ধরাও পড়ছে। তবে মূল হোতা বা ব্যবসায়ীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। একই চিত্র কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায়। সেখানেই ইয়াবার বেশির ভাগ চালান ধরা পড়ে।

তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ১০টি চালান ধরা পড়ে, বাস্তবে হয়তো তার একটি-দুটি ফোকাস হয় বা এর সংবাদ গণমাধ্যমে আসে। বাকি নয়টি চালানই ফাঁকফোকর গলে, সংশ্লিষ্ট সীমান্তররক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে বা ‘ম্যানেজ’ করে গন্তব্যে চলে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান জোরদার করলে মাদকের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমে আসে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকে। দাম বেড়ে যায়। অভিযান স্বাভাবিক হলে আবারো মহোৎসব শুরু হয়।

খোঁজ জানা গেছে, বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী কক্সবাজার জেলার এক হাজার ১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছেন তারা। তালিকার সহস্রাধিক ব্যবসায়ী সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া- টেকনাফের। গত বছরের প্রথম দিকে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ আত্মগোপনে। পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মাঝেমধ্যে দু-একজন মারা গেলেও অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র বিরোধিতায় সরব মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বন্দুকযুদ্ধের নামে চুনোপুঁটিদের মেরে ফেলে রাঘববোয়াল অপরাধীদের পরিচয় আড়াল করছে।

সাধারণ মানুষেরও একই অভিযোগ। তাদের মতে, প্রকৃতপক্ষে যারা মাদকজগতের গডফাদার, যারা ইয়াবার বড় ব্যবসায়ী তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রয়েছে বহাল তবিয়তে। আর চুনোপুঁটিরা মারা পড়ছে, নয়তো জেলে যাচ্ছে। সীমান্ত এলাকার লোকজনের দাবি, বন্দুকযুদ্ধে যেসব ইয়াবা ব্যবাসায়ী নিহত হচ্ছে তারা আসলে চুনোপুঁটি। তাদের গডফাদাররা বরাবরের মতোই থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে প্রশাসনের এত অভিযানের পরও থেমে নেই ইয়াবার আগ্রাসন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আত্মসমর্পণের প্রথম ধাপে তারা টেকনাফকেন্দ্রিক ইয়াবা কারবারিদের নজরে রাখছেন। কারণ টেকনাফ হলো ইয়াবার ‘সদর দরজা’। সেখানকার কারবারিরা আত্মসমর্পণ করলে ইয়াবার কেনাবেচা কমবে। এটা দেশের অন্য এলাকার ইয়াবা কারবারিদের জন্য একটা সতর্কবার্তা হিসেবে কাজে দেবে।

অন্যদিকে আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসার সংখ্যা কমছে বলে জানান পুলিশ-র্যাবের কর্মকর্তারা। তবে এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে উখিয়ার সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, উখিয়ার মাদক আগ্রাসন এখনো বন্ধ হয়নি। শুরু থেকে বিভিন্নভাবে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নাম উচ্চারণ হয়ে এলেও তাদের ব্যাপারে প্রশাসনের নেওয়া কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। তারা কি ইয়াবার অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন—এমন প্রশ্ন এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের।

সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে বিদেশে পলাতক অনেক ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করতে দেশে ফিরেছেন। ভারত, মিয়ানমার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে পলাতক ইয়াবা কারবারিরা দেশে ফিরে আত্মসমর্পণ করেছেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে গেছেন অনেকে। আত্মসমর্পণের জন্য বাড়ি ছাড়ার আগে কোনো কোনো ইয়াবা কারবারিকে তাদের পরিবারের সদস্যরা ‘আয়োজন’ করে ‘বিদায়’ জানান। কিন্তু গডফাদারদের বেশির ভাগ আত্মগোপনে থেকে নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কেউ কেউ ভারত, মিয়ানমার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে বসে ইয়াবার নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ক্ষেত্রে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে।

স্থানীয় পুলিশের একাধিক সূত্র জানান, দুটি কারণে এখনো ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, আগে থেকে আনা ইয়াবা এখনো কারবারিদের কাছে মজুত আছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সীমান্ত গলিয়ে এখনো কিছু কিছু ব্যবসায়ী ইয়াবা আনছেন। টেকনাফের স্থানীয় সূত্রগুলো জানান, টেকনাফে এখন যারা ইয়াবা ব্যবসা করছে তারা একেবারেই অপরিচিত মুখ। এদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর। আত্মগোপনে থাকা ইয়াবা কারবারিরা এখন এদের ব্যবহার করছে। তাই প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যায় না ইয়াবা কেনাবেচা।

সূত্র জানায়, টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এখনো ইয়াবা ঢুকছে। তবে সেটা বেশ কৌশলে আর অতি গোপনে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সীমান্তরক্ষীদের সোর্সদের ব্যবহার করছেন দরকষাকষির মাধ্যমে। সম্প্রতি নাজিরপাড়ার সীমান্ত দিয়ে দুই লাখ ৩৪ হাজার পিস ইয়াবার একটি চালান ঢোকে টেকনাফে। এর মালিক নাজিরপাড়ার রমজান আলীর ছেলে মো. তাহের। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার এ চালানটি নিরাপদে পার করতে তাহের যোগাযোগ করেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) স্থানীয় সোর্স নুর মোহাম্মদ (বশর) ও নুর মোহাম্মদ মংগিরির সঙ্গে। তাদের মাধ্যমে চূড়ান্ত দরকষাকষির পর তাহের এক লাখ ৭০ হাজার পিস ইয়াবা ঘাট দিয়ে নিয়ে যান। বাকি ইয়াবার মধ্যে ২০ হাজার পিস পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়েছে বিজিবি। আর ৪৪ হাজার পিসের কোনো হদিস নেই। এ নিয়ে তাহেরের সঙ্গে বিজিবি সোর্সের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আর এতেই ফাঁস হয়ে যায় ঘটনা। থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ায় স্থানীয় জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়—এত কড়াকড়ি আরোপের পরও কী করে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে ঢোকে। কী কারণে পার পেয়ে যায় মাদক কারবারিরা? এ ক্ষেত্রে শর্ষেতে ভূতের আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শর্ষের এই ভূতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকানো যাবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যদি সীমান্ত সিল করা গেলেই কেবল ইয়াবার আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব। সীমান্তে যারা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে আছেন তাদেরও নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে সীমান্তরক্ষীদের ওপর নজরদারির জন্য একটি গোয়েন্দা ইউনিট সৃষ্টি করতে হবে। সেটা করা সম্ভব না হলে এই সীমান্তরক্ষীদেরই কেউ কেউ ইয়াবার চালান পাচার করে আনা নিশ্চিত করবে।

এদিকে কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোমেন মণ্ডল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ইয়াবার চালান আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনো আসছে, তবে পরিমাণে খুব কম। তিনি জানান, এ মুহূর্তে টেকনাফ সীমান্ত ছাড়াও মহেশখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীসহ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে এসব চালান আসছে। বেশ কয়েকটি ধরাও পড়েছে। টেকনাফের স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা ঢোকে উপজেলার নাজিরপাড়া, বাহারছড়া ঘাট, খুরের মুখ, মুন্ডার ডেল, মহেশখালী ঘাট, শাপলাপুর ঘাটসহ অন্তত ১০টি পয়েন্ট দিয়ে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads