সোনালী ব্যাংকের জালিয়াতি ও প্রতারনা মামলায় নরসিংদীর বহুল আলোচিত ভূমিদস্যু আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় তাকে ঢাকার মালিবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে সিআইডি পুলিশ তাকে নরসিংদী মডেল থানায় তাকে হস্তান্তর করেছে।
শুক্রবার বিকালে তাকে শতকোটি টাকার মোল্লা স্পিনিং মিল অবৈধভাবে দখলের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সিআইডি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে আদালত আগামী রবিবার রিমান্ডের শুনানী ধার্য করেন।
গ্রেপ্তারকৃত আতাউর রহমান নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য। সে পুলিশের নিকট নিজেকে সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি দাবী করেছেন।
এইদিকে ভূমিদস্যু সুইডেন আতাউর গ্রেপ্তারের পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে জোরপূর্বক জমি দখল ও নির্যাতনের খবর বেরিয়ে আসছে। ভূমিদস্যু সুইডেন আতাউরের গ্রেপ্তারে স্বস্তি প্রকাশ করে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবী জানিয়েছেন ভূক্তভোগীরা।
সিআইডি পুলিশ ও নির্যাতনের শিকার লোকজন জানায়, নরসিংদী শহরের হাজিপুর এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আতাউর রহমান বাবা মমতাজ উদ্দিন ছিলেন নরসিংদী বাজারের দিনমজুর। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট আতাউর। গত ২০ বছর পূর্বে অবৈধপথে সুইডেন পাড়ি জমায়। সেখানে এক বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে গৃহ পরিচায়কের কাজ নেয়। সে সুইডেনে বসবাসের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন করে তা বাতিল হলে ওই বৃদ্ধমহিলাকে বিয়ে করে বসবাসের অনুমোদন পান। এক পর্যায়ে সে বৃদ্ধ মহিলার বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পত্তি আত্মসাত করে মালিক বনে যান। সেই টাকায় সুইডেনের স্টকহোম ক্রিসেন্টাল সংলগ্ন স্থানে রিও নামে একটি দোকান খুলেন। পরে সে সুইডেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। এক পর্যায়ে সে সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি বনে যান।
এই রাজনীতি পরিচয় ব্যবহার করে সুইডেনে সফরে যাওয়া সরকারের মন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও আমলাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে। এবং সেই সময় প্রধানমন্ত্রীসহ বড় বড় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে দেশে এর প্রভাব বিস্তার করে। বাগিয়ে নেয় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য পদ।
এরপর সে ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় ব্যবহার করে নরসিংদীতে শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন মানুষের জমি দখল ও প্রতারণায় মেতে উঠে। অল্পকিছু দিনের মধ্যেই সে শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়া এলাকায় ৬ তলা বিশিষ্ট সুইডেন ভিলা ও নরসিংদী বাজারের গেঞ্জিপট্টি মোড়ে অন্যের জমি দখল করে ৫ তলা বিশিষ্ট সুইডেন প্লাজা গড়ে তুলে। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি সুইডেন আতাউর। প্রভাব খাতিয়ে শতকোটি টাকা মূল্যের শহরের চৌয়ালা এলাকার মোল্লা স্পিনিং মিল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোড় করে দখল করে নিয়েছে। পরে সুইডেন বাংলা টেক্সটাইল নামকরণ করে তা পরিচালনা করছে। এ মিলটিকে সুরক্ষিত রাখতে সে ১০ লাখ টাকা মাসোহারার বিনিময়ে একটি প্রভাবশালী মহলের সহযোগীতায় একটি গেরিলা বাহিনী তৈরী করে। যার নেতৃত্বে ছিল র্যাবের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত পেশাদার কিলার শফিক। এই বাহিনী দিয়ে ইতিমধ্যে সে একাধিক মানুষকে হামলা ও নির্যাতনের শিকার করেছে। ফলে তার বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতো না। এই ভাবে সে পাশ্ববতী নির্মানাধীন ম্যানচেষ্টার কম্পোজিট নামক একটি কারখানা অবৈধভাবে দখল করতে মালিকদের হুমকি ধমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
মোল্লা স্পিনিং মিল দখলের অভিযোগে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে দায়বদ্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির অবৈধ দখলদার আতাউর রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার করেছে মিলটির ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট বিভাগের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় দখলদার উচ্ছেদের দাবী জানান।
প্রথমে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করলেও প্রভাবশালী মহলের নানা তদবিরে তা বাধাগ্রস্থ হয়। এরই প্রেক্ষিতে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। দেশের চলমান শুদ্ধি অভিযানের সময় এই মামলায় বহুল আলোচিত ভূমিদস্যু সুইডেন আতাউরকে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মালিবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
এদিকে তাকে গ্রেপ্তারের পর সরব হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। তিনি সুইডেন আতাউরকে মুক্ত করতে ব্যাপক চেষ্টা তদবীর চালালেও সিআইডির কঠোর অবস্থানের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
সুইডেন আতাউরের গেরিলা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন চৌয়ালা এলাকার নাজমুল মোল্লা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি চিশতিয়া সাইজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতাম। সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকের মোল্লা স্পিনিং মিলটি সুইডেন আতাউর জোরপূর্বক দখল করে নেয়। তার প্রতিবাদ করায় সুইডেন আতাউরের ভাড়াটে সন্ত্রাসী কিলার শরীফ আমাকে নির্যাতন করে পা ভেঙ্গে দেয়। ডাক্তার সেই পা কেঁটে ফেলতে বলেছিল অনেক কষ্ট করে সেই পা বাঁচিয়েছি। আমরা ভূমিদস্যু সুইডেন আতাউরের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
অভিযুক্ত আতাউরের সুইডেন প্লাজায় নিজের পৈতৃক জমি হারিয়ে দিশেহারা শহরের সাটিরপাড়া এলাকার মো. আজম খাঁন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাজারের সুইডেন প্লাজা নির্মানের সময় আমার দেড় শতাংশ জমির জোরপূর্বক সুইডেন আতাউর দখল করে নেয়। নিজের জমি ফিরে পেতে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু তাঁর অবৈধ টাকা ও ক্ষমতার কারণে কেউ আমাদের সহযোগীতা করেনি।
মোল্লা স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন মোল্লা বলেন, সুইডেন আতাউর আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি দখল করে নিয়েছে। এই ভাবে সে পাশ্ববতী ম্যানচেষ্টার কম্পোজিট নামে আরো একটি কারখানা অবৈধভাবে দখল করে নেয়। আর এসকল কাজে সে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মিল দখলের বৈধতার সার্টিফিকেট নেয়। আমরা আমাদের হারানো মিল ফিরে চাই।
সিআইডি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযুক্ত সুইডেন আতাউর নরসিংদীর বহুল আলোচিত ভূমিদস্যু। তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতি, প্রতারণার ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের একাধিক মামলা রয়েছে। এদের মধ্যে জালিয়াতি ও প্রতারণার সোনালী ব্যাংকের একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।