• সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

মেধাবীরা ভিওআইপি ব্যবসায়

কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণরাই আবারো জড়িয়ে পড়ছে ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসায়। অল্প টাকা ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি লাখপতি হওয়ার আশায় বিভোর এসব তরুণ। সেইসাথে প্রযুক্তির নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। এর আগে র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানে প্রায় বন্ধই হয়ে যায় অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কমে যাওয়ায় আবারো এ অবৈধ ব্যবসা শুরু হয়। গত বুধবার পাঁচ কোটি টাকার ভিওআইপি সরঞ্জামসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। আর রাজধানীর নিউমার্কেট, তুরাগ ও শাহআলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আটক করা তিন তরুণ হলো-বাবর, ছোটন ও রাকিব। এর আগে বছরের শেষ দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ নুরুল আমিন ওরফে শাহীন (৪৩) নামে একজনকে আটক করেছিল র্যাব।

র্যাব-১০-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান জানান, চক্রটি অবৈধ টেলিযোগাযোগ স্থাপনার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৬ লাখ আন্তর্জাতিক কল মিনিট অবৈধভাবে বাংলাদেশে টার্মিনেট করছে। সংঘবদ্ধ চক্রটির অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার কারণে সরকার দৈনিক প্রায় তিন লাখ টাকা (বর্তমান আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট অনুযায়ী) এবং বছরে প্রায় ১০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মাহফুজুর রহমান বলেন, গত ৩ ফেব্রুয়ারি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে, রাজধানী ঢাকার নিউমার্কেট থানাধীন এলিফ্যান্ট রোডের ২৭৮/৩ সরদার ভিলার ২য় তলার তালহা এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠান অবৈধ ভিওআইপির যন্ত্রাংশ বিক্রয় করছে। এমন সংবাদ পেয়ে বিটিআরসির কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চারটি সিম বক্স ডিভাইস (যার গায়ে অসঢ়ষরভরবৎ উরমরঃধষ ঝড়ঁহফ ঝুংঃবস লেখা আছে) ও দুটি মোবাইল ফোনসহ রাকিব হাসান ও বাবর উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে তুরাগ থানার রমজান মার্কেট ভাবনারটেকের জনৈক শামসুল আলমের বাড়ির একটি তালাবদ্ধ কক্ষ (যা চলমান ভিওআইপি কন্ট্রোলরুম) থেকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার চক্রের মূলহোতা কাজী এম এম মাহামুদ ছোটনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভিওআইপি ব্যবসায় ব্যবহূত ১৯টি সিম বক্স ডিভাইস, ৪১৬টি জিএসএম এন্টেনা, ৩৪শ পিস টেলিটক সিম, সাতটি মিনি কম্পিউটার, তিনটি ওয়্যারলেস রাউটার, পাঁচটি বাংলা লায়ন মডেম ও রাউটার, তিনটি ল্যাপটপসহ চারটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। র্যাব-১০-এর সিও বলেন, বিটিআরসি কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ টেলিযোগাযোগ স্থাপনার মাধ্যমে চক্রটি প্রতিদিন আনুমানিক প্রায় ৬ লাখ আন্তর্জাতিক কল মিনিট অবৈধভাবে দেশে টার্মিনেট করছিল। এতে তারা সরকারকে দৈনিক প্রায় তিন লাখ টাকা এবং বছরে প্রায় ১০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা রাজস্ব বঞ্চিত করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তাররা অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার ও ভিওআইপির যন্ত্রংশ ক্রয়-বিক্রয়কারী। তারা এক বছর ধরে কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ভিওআইপির ব্যবসায়ী চালিয়ে আসছিল। তিনি আরো বলেন, গ্রেপ্তাররা প্রযুক্তিবিদ্যায় দক্ষ। এক বছর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে তারা এ কাজ করে আসছিল। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেছেন, ‘ভিওআইপিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কোথায় কোথায় এ ব্যবসা চলছে তা গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে জেনে অভিযানও চালানো হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করেছি। তিনি বলেন, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারসহ মেধাবী লোকজন জড়িয়ে পড়েছে এ ব্যবসায়। অবৈধ এক্সচেঞ্জ ব্যবহারের কারণে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।’

বিটিআরসির তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন আড়াই কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে আসছে। কিন্তু বাস্তবে এর পরিমাণ আরো বেশি। তিন বছর আগেও যেখানে অবৈধ ভিওআইপির পাশাপাশি বছরে আন্তর্জাতিক কল থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছে ২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। সেখানে গত অর্থবছরে তা নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে। এই বছরে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৯০৫ কোটি টাকা। অথচ বৈধপথে আন্তর্জাতিক কল বাড়াতে কমানো হয়েছে ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈধপথের সাথে পাল্লা দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে অবৈধ ভিওআইপি কল। আর এ খাতে প্রতি বছর প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর সরকার হারাচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈধ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনাকারী ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটররা। গত ৯ বছরে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭৪৪ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ১০২ টাকা। তবে ওই খাত থেকে এখন প্রতিনিয়ত আয় কমছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে মাত্র ৯০৮ কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে।

সূত্র জানায়, অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে বিটিআরসি ও র্যাবের প্রতিটি অভিযানেই মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর বিপুল পরিমাণ সিম জব্দ করা হয়। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর এখন বায়োমেট্রিক ছাড়া সিম বিক্রি হওয়ার কথা নয়। তারপরও প্রতিটি অভিযানে এত বিপুলসংখ্যক সিম জব্দ করা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে এসব সিম কিভাবে অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছে যায়? বিগত ২০১৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে পরিচালিত দুটি অভিযানে দেখা গেছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় দেশের মোবাইল অপারেটরদের সিম ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়েছে। ওসব অভিযানে পাওয়া প্রায় ৫৩ হাজার সিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়েছে টেলিটক ও রবি’র সিম। ওই দুটি অপারেটরের যথাক্রমে ২১ হাজার ১৮টি এবং ২০ হাজার ৭০৯টি সিম পাওয়া গেছে। বাংলালিংক ও গ্রামীণফোনের পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৬ হাজার ৬০২টি এবং ৪ হাজার ৬৪৭টি সিম। আর মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ বছরে ২৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে বিটিআরসি ও র্যাব। ওসব অভিযানে ১৫ হাজার ৪৭৬টি সিম জব্দ করা হয়েছে ও ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৩১৮টি সিম বন্ধ করা হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, অবৈধি ভিওআইপি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি অভিযানেই বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কিছু দিনের মধ্যে তারা বেরিয়ে এসে আবারো একই ব্যবসায় জড়িত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ ভিওআইপির আড়ালে যেসব রাঘববোয়াল রয়েছে, তারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। সম্প্রতি সরকার-ঘোষিত অভ্যন্তরীণ মোবাইল কল রেট সর্বনিম্ন প্রতি মিনিট ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক আন্তঃগামী কল রেটের যে অংশ মোবাইল অপারেটররা পায়, তার মূল্য প্রতি মিনিট প্রায় ৩৩ পয়সা। তাতে আন্তর্জাতিক আন্তঃগামী কলের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কলের আড়ালে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা উৎসাহিত হচ্ছে।

এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও র্যাব গত বছরের ১৪ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার ২৬টি স্থাপনায় অভিযান চালিয়েছে। অবৈধ ভিওআইপি অভিযানে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের ৪২ হাজার ১৫০টি সিম ও ১ কোটি ২৩ লক্ষাধিক টাকা মূল্যমানের অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তা ছাড়া বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি সিম বন্ধ করে দেয়। অবৈধ ভিওআইপি অভিযানের অংশ হিসেবে সিডিআর এনালাইজার এবং জিও-লোকেশন ডিটেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহারের অপরাধে টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি শনাক্ত হয় এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন প্রতিরোধে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে সিডিআর এনালাইজের মাধ্যমে গত ১৮ নভেম্বর টেলিটকের ৩৩ হাজার ৫৩৪টি সিম অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশনে ব্যবহূত হওয়ায় শনাক্ত করা হয় এবং গত ১১ অক্টোবর একই কারণে টেলিটকের ৪৪ হাজার ৫৬টি সিম বন্ধ করা হয়। সিম বিক্রির পর কোথায় তা ব্যবহূত হচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সেটি লক্ষ্য রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

অবৈধ ভিওআইপিতে জড়িত থাকায় অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সংসদে জানান, ভিওআইপি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকা টেলিকম কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ৮৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। তার মধ্যে গ্রামীণফোনকে সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয়েছে। ওই অপারেটরটিকে জরিমানা করা হয়েছে ৪১৮ কোটি ৪০ লাখ, রবি আজিয়াটাকে ১৪৫ কোটি, বাংলালিংকে ১২৫ কোটি, র্যাংকস টেলিকমকে ১৫০ কোটি, পিপলস টেলিকমকে ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads