• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

রেলে সক্রিয় দখলদারচক্র

প্রায় ৬২ হাজার একর জমির অর্ধেকই দখলে

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

শুধু কেনাকাটা ও মেরামত প্রক্রিয়ায়ই দুর্নীতি নয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের অর্ধেক জায়গাই বেহাত হয়ে আছে। কর্মকর্তা বদলি ও পদায়ন থেকে শুরু করে সরকারি এ সংস্থাটি নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী এক চক্র। এই চক্রে রয়েছেন রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও দালালসহ রাজনৈতিক কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি। 

তারা রেলওয়ের সম্পত্তি দখল ও অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হরিলুট করছেন। কিছু জায়গায় রেললাইনের উপর বসানো হয়েছে বাজার। এসব স্থাপনায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়ায় সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। রেলের কিছু স্টেশন মাস্টার, ভূসম্পত্তি বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। 

রেলওয়ের তথ্যানুসারে, সারা দেশে রেলের মালিকানাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৬২ হাজার একর। এরমধ্যে রেল ব্যবহার করছে ৩১ হাজার ৩১১ একর। এছাড়া ৭৯৫ একর মৎস্য, ৩০ একর নার্সারি, ১২ একর সিএনজি ফিলিং স্টেশন, ৪৫ একর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২১০ একর জমি সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া আছে। আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া আছে ৯০৯ একর জমি। বাকি জমি অবৈধ দখল হয়ে আছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, রেলের জমিতে কোথাও বস্তি, কোথাও মার্কেট, কোথাও আবার গাড়ির গ্যারেজ। এভাবেই জমি দখল করে চোখের সামনেই বাণিজ্য করছে দখলদাররা। অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কিছু কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও রয়েছে এসব দখলের নেপথ্যে। এসব স্থাপনা থেকে স্থানীয় থানার পুলিশও নিয়মিত চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে যারা অনুমোদন (ইজারা) নিয়ে ভোগ করছেন রেলের জমি, তাদের অনেকেই মানছেন না শর্ত। রেললাইন থেকে ২৫ ফুট দূরে স্থাপনা নির্মাণের নিয়ম থাকলেও তারা মানছেন না। কেউ আবার শর্ত ভেঙ্গে নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবনও। তবে এমন বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে রেল মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশল বিধিমতে, রেলপথের দু ধারে খালি জায়গা থাকা আবশ্যক। সর্বনিম্ন ১৪ দশমিক ৩ ফুট এবং সর্বোচ্চ ৩০ ফুট জায়গা খালি রাখতে হয় নিরাপদ দূরত্ব হিসেবে। এরমধ্যে কোনো স্থাপনা তৈরির সুযোগ নেই। স্থাপনা তৈরি করলে বিনা নোটিসে তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার আইন রয়েছে।

এছাড়া দখল করা জমি উদ্ধারে রেলের রয়েছে বিভাগীয় এস্টেট অফিসার, সহকারী এস্টেট অফিসার, সার্কেল অফিসার, কানুনগো। আর রেলভূমি রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত আছে প্রকৌশল বিভাগ। এরপরও প্রতিনিয়ত বেদখল হচ্ছে জমি। এতে রেল কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। রেল মন্ত্রণালয়ও বহুবার নির্দেশ দিয়েছে

বেআইনি দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানের। তবে উচ্ছেদ অভিযানের নামে কেবল নাটক হয়েছে। অবৈধ দখলের বিষয়ে অবহিত করলে শুধুমাত্র তখনই উচ্ছেদ অভিযানের ব্যবস্থা নেয় ভূসম্পত্তি বিভাগ। এই বিভাগটির রয়েছে জনবল সংকট, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকট। ফলে বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় স্থবিরতা বিরাজ করছে।

সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনের আশপাশে রেলের ৫৮ একর জমির মধ্যে ১১ একর বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমিতে গড়ে উঠেছে ট্রাকস্ট্যান্ড, বস্তি, বহুতল আবাসিক ভবন, ক্লাবের কার্যালয়, মাঠ ও ফলের আড়ত। রয়েছে মসজিদ, বিদ্যালয়, মাদরাসা ও মন্দির। অবৈধভাবে দখল করা জমি থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৭৫ লাখ টাকা তোলে দখলদাররা। অথচ তেজগাঁও রেলস্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূসম্পত্তি থেকে মাসে আয় হয় মাত্র এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

এছাড়া স্টেশনের পূর্বপাশে গড়ে উঠা ট্রাকস্ট্যান্ডের দখলে আছে সবচেয়ে বেশি জমি। এখানে রেলের জমির পরিমাণ পাঁচ একরের বেশি। এখান থেকে দখলদাররা প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে। এর পরই সবচেয়ে বেশি জমি দখল করে গড়ে উঠেছে পাঁচ-ছয়টি বস্তি। এসব বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এসব বস্তি থেকে ভাড়া হিসেবে নিয়ন্ত্রণকারীরা তুলে নিচ্ছেন মাসে প্রায় ৯ লাখ টাকা। স্টেশনের উত্তর পাশের কালামগাঁও হিসেবে পরিচিত আবাসিক এলাকায় রেলের এক একরের বেশি জমি দখল হয়ে গেছে। এখানে দখলদারির অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে। এই জমির কিছু বিক্রি হয়ে গেছে, কিছু জমির উপর ভবন উঠেছে, যেখান থেকে ভাড়া উঠে মাসে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা। আর ক্লাবের দখল করা জায়গায় রয়েছে বস্তি ও দোকানপাট। এর আয়ও নিচ্ছে ক্লাব, যার পরিমাণ মাসে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার পাশেই অস্থায়ী ফলের আড়ত তৈরি হয়েছে। এসব আড়ত থেকে টাকা তোলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। এর পরিমাণও মাসে আট-দশ লাখ টাকা।

তেজগাঁও রেলস্টেশনের প্রায় পাঁচ একর ১০ শতাংশ জমি দখল করে গড়ে উঠেছে ট্রাকস্ট্যান্ড ও দোকান। মালিক ও শ্রমিকদের তিনটি সংগঠন এই স্ট্যান্ড পরিচালনা করে। ওই স্ট্যান্ডে ছোট-বড় মিলিয়ে ট্রাক রাখা যায় প্রায় এক হাজার ২০০টি। এখানে এক দিন ট্রাক রাখলে দিতে হয় ১৪০ টাকা, যেটাকে তারা চাঁদা বলছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৭০০ ট্রাক থাকলে মাসে ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। সঙ্গে ট্রাকস্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা মেরামতের দোকান ও মার্কেটের দোকান ভাড়াও আছে লক্ষাধিক।

তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের উপর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে একটি মাঝারি মানের আবাসিক এলাকা। স্থানীয় লোকজন চেনে কালামগাঁও নামে। উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কালাম হাজির নামে এলাকাটির নাম হয়ে গেছে। রেলের দাবি, আওয়ামী লীগ নেতা কালামের নেতৃত্বে রেলের এক একর ১৫ শতাংশ জমি দখল করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, জাল দলিল করে তিনি নিজের জমি বলে অনেক জমি বিক্রি করেছেন। সরেজমিনে কথিত দখলি জমিতে ১৭টি প্লটে একতলা থেকে শুরু করে বহুতল আবাসিক ভবন রয়েছে। জানা গেছে, ২০ বছর আগে যখন সিটি জরিপ হয়, তখন ওই জমি বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন। রেকর্ড সংশোধনের জন্য রেল কোনো আপিল করেনি। তবে জমির মালিকানা নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে একটি মামলা বিচারাধীন। হাইকোর্ট স্থিতাবস্থার আদেশ দেওয়ায় রেল দখলদারদের উচ্ছেদও করতে পারছে না।

তেজগাঁও রেলস্টেশনের দক্ষিণপাশে রেল কলোনির ভেতরে খেলাঘর ক্লাবের কার্যালয় ও মাঠ। এই ক্লাবের দখলে রেলের প্রায় এক একর ৫ শতাংশ জমি। ক্লাবের কার্যালয় ও মাঠ ঘিরে প্রায় ৩০০ ঘরের বস্তি ও বেশ কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। বস্তির ঘরের ভাড়া নেয় ক্লাব। 

রেল মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্ত অভিযোগের তথ্য সূত্রে আরো জানা যায়, চট্টগ্রামেও প্রতিদিন প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে রেলের মূল্যবান জমি। রাতারাতি এতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে কিছু রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রশ্ন উঠছে, রেলওয়ের প্রকৌশল এবং এস্টেট বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে। দখল হওয়া জায়গায় রাতারাতি গড়ে তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, বিভিন্ন সংগঠনের অফিস, ক্লাব, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা। আর এসবের বিপরীতে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের উচ্ছেদ অভিযানেও রয়েছে স্থবিরতা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তাকে একটি অভিযাগপত্র দিয়েছে যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ওই অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া গঙ্গাসাগর এলাকায় রেলওয়ে স্টেশন এবং রেল লাইনসহ অপারেশনাল কাজে ব্যবহারের ৪ হাজার ৩৯৬ একর জায়গায় কোনো ইজারা না দেওয়ার পরও ১৬৯ দশমিক ৮২ একর জায়গায় বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। 

সংগঠনটি আরো জানায়, চট্টগ্রামে রেলকে ঘিরে মাফিয়াচক্র সংস্থাটির জায়গায় অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হরিলুট চালাচ্ছে। কিছু জায়গায় রেললাইনের উপর বাজার বসানো হয়েছে। এসব কাজে জড়িত রেলেরই কিছু স্টেশন মাস্টার, ভূসম্পত্তি বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিভিন্ন সময়ে দেশের গণমাধ্যমে বেশকিছু সংবাদ প্রকাশ হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি সংগঠনটির।

যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বলছে, রেললাইনের পাশে গড়ে উঠা এসব স্থাপনা থেকে বিভিন্ন সময় রেলযাত্রীদের উপর পাথর নিক্ষেপ, ছিনতাই ও চুরির ঘটনা ঘটছে। রেললাইনের পাশে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা থাকায় অপরাধীরা ট্রেন থেকে নেমে সহজে এসব স্থাপনায় আত্মগোপন করতে পারে। শুধু সাধারণ যাত্রী নয় ২০১৭ সালে এসব অবৈধ স্থাপনা থেকে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করায় ডিউটিরত অবস্থায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার এসআই সালাউদ্দিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তারপরও এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নীরব অবস্থান। 

এ বিষয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার রেলপথে যাত্রী সাধারণকে নিরাপদ নির্বিঘ্ন সেবা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিছু ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে সরকারের সব অর্জন ম্লান হচ্ছে। সমপ্রতি আমাদের (যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ) সংগঠনের একটি টিম নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইনের প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে গেলে আমরা দেখতে পাই নগরের ষোলশহর, জানআলী হাট, পটিয়া দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন, রেললাইনসহ অপারেশনাল কাজে ব্যবহারের জায়গাগুলো এখনও অবৈধ দখলদারদের হাতে। এসব স্টেশনের মাস্টারদের ছত্রচ্ছায়ায় রেললাইনের উপর বাজার, রেললাইনের পাশঘেঁষে অবৈধ বস্তি, দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনা থেকে মাসে লাখ লাখ টাকাও চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম চললেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে উদাসীন।

এদিকে, সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে জমি উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করা হবে উল্লেখ করে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলের জায়গা সময়মতো রেল নিয়ে নেবে। জনবল সংকটের কারণে রেলের জায়গা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে, জনবল বাড়িয়ে উদ্ধার করা হবে রেলের জায়গা। তাছাড়া, তেজগাঁও স্টেশন নিয়ে আমাদের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। তা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। তখন এই জায়গাগুলো আমাদের দরকার হবে।

বস্তির প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন,  শুধু বস্তি উচ্ছেদ করলেই হবে না, সেই জায়গাকে রেলের কাজে ব্যবহারও করতে হবে। তাই এ নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা চলছে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads