• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯
সীমান্তের ৪০ কারখানার ইয়াবা ঢুকছে টেকনাফে

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

ইতিহাসের সবচেয়ে বড়চালান জব্দ

সীমান্তের ৪০ কারখানার ইয়াবা ঢুকছে টেকনাফে

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান আটক করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী ব্রিজের কাছাকাছি একটি বোট থেকে প্রতি বস্তায় ২ লাখ করে ৭ বস্তায় মোট ১৪ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এ সময় আটক করা হয়েছে দুজনকে। এদিকে একই দিন ভোরে বিজিবি টেকনাফে ইয়াবা কারবারির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত ও ৫২ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এর আগের দিনও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই ইয়াবাকারী নিহত হয়। উদ্ধার হয় ১ লাখ পিস ইয়াবা।

গত জানুয়ারি মাসেই শুধু বিজিবি প্রায় ১৫ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করেছে। এর মধ্যে ১৭ জানুয়ারি ওই মাসের সবচেয়ে বড় চালান সাড়ে ৫ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।

ইয়াবার চালান আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে মনে করছেন অনেকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সজাগের কারণে ধরা পড়ার ঘটনাও বাড়ছে।

১৪ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ : গতকাল মঙ্গলবার কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল-চৌফলদণ্ডী ব্রিজের পাশে ভারুয়াখালী খালে নোঙর করা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে সাত বস্তা ইয়াবা উদ্ধার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সাত বস্তায় ১৪ লাখ ইয়াবা ছিল। আর এটিই হচ্ছে দেশের ইতিহাসে উদ্ধার হওয়া সবচেয়ে বড় ইয়াবা চালান আটকের ঘটনা। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। ইয়াবা চালানের সঙ্গে ট্রলার মালিকসহ দুই পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তাররা হলেন ট্রলার মালিক কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার মোজাফফরের ছেলে মোহাম্মদ বাবু (৫৫) ও একই এলাকার রাজু মেম্বারের ছেলে মোহাম্মদ ফারুক (৩৭)।

ডিবি ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, গোপন সংবাদ আসে চৌফলদণ্ডী ব্রিজ এলাকায় ভারুয়াখালী খালে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চালান রয়েছে। সেই খবরের ভিত্তিতে পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। পুলিশের কয়েকটি দলের সমন্বয়ে চালানো এ অভিযানে নৌকা থেকে ইয়াবাভর্তি সাতটি বস্তা উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি বস্তায় ২৫ থেকে ৩০ কার্টন ইয়াবা পাওয়া গেছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, উখিয়ার ইনানীর রেজুরখাল মোহনা থেকে ইয়াবার বিশাল এ চালানটি তারা গ্রহণ করে চৌফলদণ্ডী ঘাটে এনে খালাসের অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আরো বলেন, চক্রের দুজনকে যেহেতু হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে, তাদের সঙ্গে জড়িত বাকি সদস্যদের ব্যাপারেও খোঁজ পাওয়া যাবে।

ইয়াবা বড় চালান জব্দের ঘটনা

১৩ লাখ ইয়াবা জব্দ : গত বছরের ২৪ আগষ্ট কক্সবাজার সদর থেকে র্যাব-১৫-এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে একটি ট্রলার থেকে ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেন। ওই ঘটনায় এক রোহিঙ্গাসহ দুজনকে আটক করা হয়। এর আগে এটিই ছিল দেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান উদ্ধারের ঘটনা।

র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে ট্রলারযোগে বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চালান আসার খবরে র‍্যাবের একটি দল সাগরে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে গভীর সাগরে সন্দেহজনক একটি ট্রলার দেখতে পেয়ে র‍্যাব সদস্যরা নজরদারি জোরদার করে। পরে ধাওয়া দিলে ট্রলারটি বাঁকখালী নদীর কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল এলাকায় অবস্থান নেয়। এ সময় ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গাসহ দুজনকে আটক করা হয়। পরে ট্রলারটিতে তল্লাশি করে পাওয়া যায় ১৩ লাখ ইয়াবা।

১০ লাখ ইয়াবা জব্দ : ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। নৌবাহিনীর চোরাচালান প্রতিরোধ দলের সদস্যরা এ অভিযান পরিচালনা করে।

জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর বাংলাবাজার ঘাটে ইয়াবার চালান খালাস হবে এমন গোপন সংবাদ ছিল। এ কারণে বন্দরের ১ নম্বর বয়ার কাছে এবং কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে নৌবাহিনীর চোরাচালান প্রতিরোধ দলের সদস্যরা অবস্থান নেন। বন্দরের ১ নম্বর বয়ার অদূরে ‘এফবি রাজীব’ নামে কাঠের তৈরি একটি মাছ ধরার ট্রলারের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তা থামতে সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু ট্রলারটি কর্ণফুলী নদীর দিকে না এসে গতিপথ পরিবর্তন করে। এ সময় স্পিডবোট নিয়ে ধাওয়া করলে চোরাকারবারিরা ট্রলারটি নিয়ে আনোয়ারার পার্কি সৈকতের দিকে ছুটতে থাকে। উপকূলের কাছাকাছি যাওয়ার পর ট্রলার থেকে সাত-আটজন চোরাকারবারি পানিতে ঝাঁপ দেয়। তারা সাঁতরে উপকূলের দিকে পালিয়ে যায়। পরে ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে স্কচটেপ মোড়ানো প্যাকেটভর্তি এসব ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১১টি বড় কার্টনে ১০ লাখ ইয়াবা বড়ি ছিল।

৮ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ : ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে আট লাখ পিস ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা যুবককে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫)। আটক রোহিঙ্গা যুবকের নাম জামাল হোসেন (২২)।

র্যাব জানায়,  সমুদ্র পাড়ি দিয়ে উখিয়ার ইনানীর পাটুয়ারটেক সমুদ্রসৈকত এলাকা দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় একটি চালান ঢুকবে এমন খবর পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে র্যাবের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়।  এ সময় ট্রলারে থাকা বস্তাভর্তি আট লাখ পিস ইয়াবাসহ জামালকে আটক করা হয়।

৫ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ : চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি)-এর অধীনস্থ দমদমিয়া বিওপি’র দায়িত্বপূর্ণ ওমরখাল এলাকা দিয়ে মিয়ানমার হতে নাফ নদী পার হয়ে ইয়াবার একটি বড় চালান বাংলাদেশে পাচার হতে পারে। উক্ত সংবাদের ভিত্তিতে দমদমিয়া বিওপি’র একটি বিশেষ টহলদল কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে দ্রুত বর্ণিত এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ লক্ষ বিশ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়।

৪ লাখ ইয়াবা জব্দ : গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ৪ লাখ ২৪ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে বিজিবি।  কর্মকর্তারা জানান, টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় আইয়ুবের জোড়া এলাকাসংলগ্ন নাফ নদ দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার একটি বড় চালান বাংলাদেশে ঢোকার গোপন খবর আসে। এর ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে অভিযান চালায় বিজিবির দমদমিয়া বিওপির বিশেষ টহল দল। পরে বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে পাচারকারীরা পাঁচটি বস্তা ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এরপর ওই বস্তাগুলোতে ৪ লাখ ২৪ হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া যায়।

৫ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ : ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি কক্সবাজারের গভীর সমুদ্র এলাকা থেকে ৫ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। এ সময় ফিশিং ট্রলারসহ আটজনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন।

এছাড়া প্রায় প্রতিনিয়িত ছোটখাটো ইয়াবার চালান জব্দের ঘটনা ঘটছে।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেকনাফ থেকে ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫৫টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হয়েছে। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। মামলা হয়েছে ৪০টি।

সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের ৩৫টি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। শুধু স্থলপথ নয়, আসছে সাগরপথেও। নিত্যনতুন কৌশলে মাদকের চোরাচালান আসছে। কখনো ত্রাণবাহী কিংবা জরুরি পণ্যবাহী যানে; মাছ ধরার ট্রলার, কাভার্ডভ্যান, কখনো পায়ুপথে, কখনো যানবাহনের ইঞ্জিনের কাভারে করে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে ইয়াবা। টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, দমদমিয়া, লেদা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীয়াপাড়া, শাপলাপুর, সাতঘরিয়াপাড়া, উখিয়ার আমতলি, পালংখালী, মরিচ্যা, রেজুখাল, নাইক্ষ্যংছড়ির গর্জনবুনিয়া, তুমব্রুসহ অন্তত ৩৫টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে। রোহিঙ্গা শিবির-সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে ইয়াবা আসছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের পরও প্রতিদিন কোনো না কোনো পয়েন্ট থেকে ইয়াবাসহ পাচারকারী বা পরিত্যক্ত ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছেই। এভাবেই প্রতিনিয়ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কৌশলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা চালান নাফ নদী ও সমুদ্রপথে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। গত ৩১ জুলাইয়ের পর ইয়াবার চালান তুলনামূলক হারে কমে এলেও সম্প্রতি কিছুটা বেড়ে যায়। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ করে বৃহৎ আকারের ইয়াবার চালান আটকের ঘটনায় আবারো নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকেই জানিয়েছেন, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবাসহ মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। যার ফলে এ পর্যন্ত বড় কোনো ইয়াবা কারবারি আটকের খবরও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি আত্মসমর্পণকারী সীমান্তের ইয়াবা গডফাদারদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে বহাল তবিয়তেই ইয়াবা কারবার চালাচ্ছে নতুন করে।  ‘ইয়াবার গেটওয়ে’ হিসেবে পরিচিত টেকনাফের খুব কাছাকাছি মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে প্রায় ৪০টি ইয়াবা কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার চালান আসে একমাত্র টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সৌমেন ম্লল জানান, সীমান্তে যে-কোনো মূল্যে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকের চোরাচালান বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার। ইয়াবা পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ইয়াবার চালান বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। আমরা বসে নেই, প্রতিনিয়ত চলছে আমাদের মাদকবিরোধী অভিযান।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৬০ জন গডফাদারসহ ১১৫১ জন মাদক কারবারির তালিকা প্রকাশ করে সরকার। এই তালিকায় টেকনাফ সীমান্তেরই রয়েছে ৯ শতাধিক ইয়াবা কারবারি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads