• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

বোমা হামলার ছক জেএমবির

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১২ আগস্ট ২০২১

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের হামলার জন্য সংগঠন গুছিয়েছে নব্য জেএমবি। এজন্য বোমা তৈরিতে যুক্ত হয় সদ্য যোগ দেওয়া একদল তরুণ। তারা ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে নাশকতারও পরিকল্পনা করে। ইতোমধ্যে ঢাকার বাইরে অন্তত ১২টি স্থানে দূরনিয়ন্ত্রিত রিমোর্ট কন্ট্রোল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা। এজন্য নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নেয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এখান থেকেই কাটআউট পদ্ধতিতে ভাগ হয়ে বান্দরবানের গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তোলে। সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল ইউনিটের একটি টিম বিশেষ অভিযানে নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষক ও বোমা প্রস্তুতকারকসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল বুধবার ভোরে রাজধানীর কাফরুল থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলেন-জাহিদ হাসান ওরফে রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে ফোরকান ভাই, সাইফুল ইসলাম মারুফ ওরফে বাসিরা ও মো. রুম্মান হোসেন ফাহাদ ওরফে আব্দুল্লাহ। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিস্ফোরক দ্রব্য, জিআই পাইপ, রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস, লোহার বল, সাংগঠনিক কাজে ব্যবহূত তিনটি মোবাইল ফোন ও একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়।

এ তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এর আগেও আমরা কয়েকটি গ্রুপকে গ্রেপ্তার করেছি। একেকটি গ্রুপকে গ্রেপ্তারের পর তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ধরে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে আরেকটি গ্রুপকে গ্রেপ্তার করা হয়। নব্য জেএমবির এই গ্রুপটি বোমা বানাতে বিশেষ পারদর্শী। বিশেষ করে জাহিদ ওরফে ফোরকানের নেতৃত্বে গ্রুপটি সারাদেশে হামলার ছক আঁকছিল। বয়সে তরুণ এ গ্রুপটি ড্রোন দিয়েও হামলার পরিকল্পনা করেছিল। এর আগেও তারা বেশ কিছু স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টার্গেট করে রিমোর্ট কন্ট্রোল বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বড় ধরনের কোন ক্ষতি না হলেও তাদের ধ্বংসাত্নক পরিকল্পনা ছিল। আর এই বোমার তদন্ত করতে গিয়েই খোঁজ মেলে এই গ্রুপের। তিনি বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপ ব্যবহার করে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিত ফোরকান। গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় নব্য জেএমবির সদস্যরা। বোমাগুলো ছিল একই প্যাটার্নের। যারা বোমাগুলো বানায় তাদের বিভিন্ন সময় অভিযানে গ্রেপ্তার করা হলেও নতুন করে আবার মেলে একই প্যাটার্নের বোমার খোঁজ। এ ঘটনায় তদন্তে নামে সিটিটিসি।

তিনি বলেন, সর্বশেষ জাহিদ ড্রোন বানানোর পরিকল্পনা করেছিল। ড্রোনের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ যুক্ত করে কোনো জায়গায় আক্রমণের পরিকল্পনাও করে। পাশাপাশি নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান নিযুক্ত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, পুলিশ বক্সে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত ছিল। আমিরের নির্দেশে যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে সেসব হামলায় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে জাহিদ। সিটিটিসি প্রধান বলেন, জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ায় এবং হিজরত করায় মাস্টার্স সম্পন্ন করতে পারেনি জাহিদ। ২০১৬ সালে অনলাইনে ‘হোয়াইট হাউজের মুফতি’ নামে আইডির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব্য জেএমবির তৎকালীন আমির মুসার হাত ধরে সে এই সংগঠনে যোগদান করে। আমির মুসার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সংগঠনের ওই সময়ের শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিদের নজরে আসে এবং তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে কাজ করে।

তিনি বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জিএমবির শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা গ্রেপ্তার, নিহত হলে এই সংগঠনটি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় জাহিদ গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য আত্মগোপনে চলে যায়। পুনরায় সে নতুন আমিরের নেতৃত্বে সংগঠনকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। তারই অংশ হিসেবে অনলাইনে অত্যন্ত সাহসী ও সামরিক বিভাগে কাজ করতে আগ্রহীদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের টাইম ও রিমোট কন্ট্রোল বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিত জাহিদ। ‘সংগঠনটির কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিকবার মিটিং করেছিলো ফোরকান। এমনকি সে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের আওতাধীন মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম থেকে কারাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। বড় কোনো কেমিক্যাল সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি করে সেখান থেকে এক্সপ্লোসিভ প্রিকারস নিয়ে আইইডি বানানোর পরিকল্পনা ছিল তার।’ সিটিটিসি প্রধান আরও বলেন, গ্রেপ্তার অপর অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম মারুফ একজন দক্ষ বোমা তৈরির কারিগর। সে অনলাইনে ফোরকান ওরফে জাহিদের কাছ থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। বেশ কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে সে। সাইফুল ইসলাম মারুফ এবং গ্রেপ্তার রুম্মান হোসেন ফাহাদ সংগঠনের সিদ্ধান্তে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার লক্ষ্যে বান্দরবান এলাকায় হিজরত করে। সংগঠনের ফান্ড তৈরির জন্য ইলেকট্রিক শক থেরাপির মাধ্যমে অজ্ঞান করে ছিনতাই ও ডাকাতি করার জন্য টঙ্গী থানার রেলগেট এলাকায় রুম ভাড়া নেয় তারা।

বোমা মিজান খ্যাতি পায় জাহিদ : ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে জেএমবির তিন শীর্ষ নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ায় জড়িত ছিলেন জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজান।

বলা হয়, একুশ শতকের শুরুর দিকে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবার কুখ্যাত জঙ্গি নসরুল্লাহর কাছ থেকে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন মিজান। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে লস্কর-ই-তৈইয়েবার ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ নেন এবং ভারতে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। বোমা তৈরির দক্ষতার কারণেই সংগঠনে তার নাম হয় ‘বোমা মিজান’ বা ‘বোমারু মিজান’।

জেএমবি’র সেই বোমা মিজান ভারতে গ্রেপ্তারের পর তার অনুপস্থিতিতে নব্য জেএমবিতে বোমা মিজান খ্যাতি পান সামরিক শাখার প্রধান জাহিদ। রসায়নের ছাত্র হওয়ার সুবাদে নতুন কৌশলে আইইডি, বোমা ও গ্রেনেড তৈরিতেও দ্রুত পারদর্শী হওয়ায় জাহিদ নব্য জেএমবিতে এই খ্যাতি পান।

কে এই জাহিদ : সিটিটিসি জানায়, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ জানান, ‘তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র হিসেবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু জঙ্গিবাদে জড়িয়ে এবং হিজরত করার (অন্য জায়গায় যাওয়া) কারণে তিনি তার মাস্টার্স কোর্স শেষ করতে পারেননি।’

জাহিদ ২০১৬ সালে নব্য জেএমবির তৎকালীন আমির মুসার মাধ্যমে জঙ্গিবাদী জড়িয়ে যায় বলে জানান আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, জাহিদ ‘হোয়াইট হাউসের মুফতি’ নামের একটি ফেসবুক আইডির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসার সঙ্গে পরিচিত হয়। মুসার কাছাকাছি থাকায় তখনকার সময়ের শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে জাহিদের সখ্য তৈরি হয়। মেধা ও দক্ষতার কারণে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা তাকে সামরিক শাখায় নিয়োগ দেয়।

‘এরপর অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি বোমা ও গ্রেনেড তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই জাহিদ সামরিক শাখার সদস্যদের হাতে কলমে বোমা-গ্রেনেড এবং আইইডি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিলেন।’ জাহিদ ওরফে ফোরকানকে এতদিন কেন গ্রেপ্তার করা যায়নি, তার কারণ ব্যাখ্যা করেন আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষপর্যায়ের জঙ্গিরা ইতোমধ্যে মারা গেছেন অথবা গ্রেপ্তার হয়েছেন, কিন্তু জাহিদ তার মেধা এবং সাহসের কারণে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

‘কিছুদিন ধরে নতুন আমিরের নেতৃত্বে সংগঠনকে আবারও সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সে তার সংগঠনের সাহসী জঙ্গিদের বোমা তৈরির জন্য অনলাইনে ভিডিও টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল। অনলাইনে আইডি খোলার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অত্যন্ত সাহসী ও সামরিক বিভাগে কাজ করতে আগ্রহীদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের টাইম ও রিমোট কন্ট্রোল বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিত।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও জাহিদ তৎপরতা চালাতেন বলেও জানান সিটিটিসির প্রধান। তিনি বলেন, সংগঠনটির কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিকবার মিটিংও করে। সেখান থেকে একেকটি গ্রুপ নিয়ে বান্দরবনের গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads