• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

নেশায় বুঁদ অভিজাত এলাকার তারুণ্য

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৮ আগস্ট ২০২১

রাজধানীর গুলশান-১-এর ১২৮ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাসা। সবাই জানত এটি কালাম রিয়েল এস্টেটের অফিস। কিন্তু এর আড়ালে মাদকের রমরমা কারবার চলতো সেখানে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উত্তরের একটি দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হানা দেয় সেখানে। অভিযানে মেলে ১৫০ বোতল বিদেশি মদ।

অভিযানে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলেন, বাসার ভেতর থাকা নানা আসবাবপত্র রক্ষিত ছিল মদের বোতলগুলো। আলমারী, খাট, ওয়ারড্রব থেকে শুরু ব্যবহূত সকল জিনিষপত্রের মধ্যেই এগুলো লুকায়িত অবস্থায় ছিল। অভিযানে মোট ৪ জনকে আটকও করা হয়।

ডিএনসির উত্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদি হাসান বলেন, আবাসন ব্যবসার আড়ালে আটক ফয়সাল দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে মাদকের ব্যবসা করে আসছিলেন। তার বাসার আলমারি থেকে শুরু করে সব জায়গায় মদের বোতল পাওয়া গেছে। তারা এসব মদ কোথা থেকে সংগ্রহ করতেন কিংবা তাদের কাছে কারা পৌঁছে দিত তা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে।

তিনি বলেন, ফয়সালের কাছে ২০০৯ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদকের লাইসেন্স থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা নবায়ন করা হয়নি। আর মাদকের নিজস্ব লাইসেন্স থাকলে সে বিষয়টি পরিপ্রেক্ষিতে এত মাদক মজুত কিংবা সংরক্ষণ করার আইনগত কোনো বৈধতা নেই।

গত ২১ আগস্ট বনানী ও উত্তরা থেকে ভয়ঙ্কর মাদক আইস কেনাবেচায় জড়িত সিন্ডিকেটকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে অর্ধকোটি টাকা সমমূল্যের ৫০০ গ্রাম আইস (ক্রিস্টাল মেথ) ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। বনানী ও উত্তরা এলাকায় আইস কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের প্রায় সব সদস্যকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএনসি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান।

এদিকে সময়ে ক্লাব ও বারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে কারবারিরা বাসায় মজুত করছে। আর বাসা থেকেই বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে। শুধু মদ নয়, ইয়াবা, নতুন মাদক এলএসডি, সিসাসহ নানা মাদকে বুঁদ অভিযাত এলাকার তরুণসমাজ।

এর আগে গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনার সূত্র ধরে আলোচনায় আসে নতুন মাদক লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি)। পুলিশের অভিযানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, সিসা বারের আড্ডা থেকে এলএসডি গ্রুপ তৈরি করেন তারা। কয়েকজনের কাছ থেকে সিসার উপাদানও জব্দ করা হয়। সমপ্রতি র্যাবের অভিযানে এলএসডি, আইসসহ নতুন মাদক উদ্ধারের সময়ও মিলেছে সিসার উপাদান।

গত ২৮ জানুয়ারি উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ব্যাম্বো শুট নামে একটি রেস্টুরেন্টে ভেজাল মদ সেবন করে অসুস্থ হয়ে পড়া তিন শিক্ষার্থী পরে মারা যান। ওই ঘটনার তদন্তকারীরা জানান, রেস্টুরেন্টে সিসা লাউঞ্জের আড্ডা থেকে মাদক সেবনে আসক্ত হন শিক্ষার্থীরা। কয়েক দিন আগে ঢাকায় শুরু হওয়া মাদক-প্রতারণাসহ অনৈতিক কারবারের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজসহ কয়েকজনের বাসা থেকেও জব্দ করা হয়েছে সিসার উপাদান। তদন্তকারীরা বলছেন, সিসা লাউঞ্জে মদের বারের মতোই আলো-আঁধারী পরিবেশে আড্ডাবাজি এবং গাঁজা, ইয়াবা, মদসহ বিভিন্ন মাদক সেবন থেকে ভয়ংকর মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), পুলিশ, র্যাবসহ গোয়েন্দারা সিসা বারে গিয়ে তরুণ-তরুণীদের ভয়ংকরভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ার তথ্য পেয়েছে অনেক আগেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের নতুন আইনে সিসা নিষিদ্ধও করা হয়েছে। সিসার ফ্লেভারে অ্যালকোহল, ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য মিশিয়ে তরুণ সেবীদের আসক্ত করে তোলার চেষ্টা করছেন অসাধু কারবারিরা। সিসা লাউঞ্জ থেকেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মাদকের গ্যাং গ্রুপে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু রেস্টুরেন্টে খাবারের পর ‘ডেজার্টের’ আদলে সিসা পরিবেশন করা হয়।

আইনের ফাঁকে এসব সিসার লাউঞ্জ চালাচ্ছেন রেস্টুরেন্ট ও হোটেল ব্যবসায়ীরা। আইনে উল্লেখ আছে, সিসার মলাসেস বা ফ্লেভারে ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন থাকলে তা অবৈধ। কম নিকোটিন আছে দাবি করে বহাল থাকতে চাইছেন মালিকরা। ঢাকার সাতটি সিসা বারের মালিক অভিযান ঠেকাতে উচ্চ আদালতে রিটও করেছেন। তবে ডিএনসি ২৩টি সিসা লাউঞ্জ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে যাচাই করে প্রতিটিতে ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পেয়েছে। অথচ ফ্লেভারের প্যাকে ২ শতাংেশর কম লেখা ছিল। সিসার ফ্লেভারে আর কী উপাদান আছে, তা পরীক্ষার জন্য ভিন্ন পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে প্রভাবশালী সিসা লাউঞ্জের মালিকদের রিট করে বহাল থাকার চেষ্টায় অভিযান থেকে পিছু হটেছেন বলে দাবি করছেন ডিএনসির কর্মকর্তারা। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অভিযান বন্ধ রাখতে ঘুষও দিচ্ছে সিসা লাউঞ্জগুলো। এ কারণে অভিযান নিয়ে চলছে লুকোচুরি। এখন বন্ধ থাকলেও লকডাউন শিথিল হলেই মালিকরা সিসা বারগুলো চালুর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। লকডাউনের মধ্যে হাউস পার্টিতে মদের সঙ্গে সিসা সরবরাহ করেন লাউঞ্জের কারবারিরা। এমন কয়েকটি হাউস পার্টিতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ ও র্যাব।

ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল বলেন, ‘সিসার ব্যাপারে আমাদের নজরদারি আছে। রিট করার পরও আমরা আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছি। এবারের পরীক্ষার রিপোর্ট এলেই অ্যাকশনে যাব।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সবচেয়ে বেশি সিসা লাউঞ্জ আছে বনানী ও গুলশান এলাকায়। সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের লাউঞ্জগুলো বন্ধ রাখা হলেও শিগগিরই চালুর প্রস্তুতি চলছে। 

বনানীর ডি-ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ৬৬ নম্বর বাড়িতে আরগিলা, বনানী কবরস্থানের কাছে ফিউশান হান্ট, বনানীর ই-ব্লকের ১২/বি রোডের ৭৭ নম্বর বাড়িতে আল গ্রিসিনো, বনানীর জি-ব্লকের ১১ নম্বর রোডের ৩২ নম্বর বাড়িতে ব্ল্যাক ব্রিচ কিচেন অ্যান্ড লাউঞ্জ, ১৫৩ নম্বর বাড়িতে মিন্ট আল্ট্রা লাউঞ্জ এবং বনানী ১১ নম্বর রোডের এআর রেস্টুরেন্ট সিসা বার লুকোচুরি করে চলছে।

সূত্র মতে, এসব লাউঞ্জ থেকে সিসার ফ্লেভার পরীক্ষায় বেশি নিকোটিন পাওয়া যায়। একইভাবে বনানীর ফ্লোর-সিক্স রিলোডেড, লাল সোফা, কিউডিএস, রিলোডেট, গোল্ডেন টিউলিপ, টিজেএস, পেট্টাস ও ফারহান নাইট, দ্য নিউ ঢাকা ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে, বনানী ১১ নম্বর রোডের এইচ-ব্লকের ৫২ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত প্লাটিনাম গ্র্যান্ড আবাসিক হোটেলে সিসা পরিবেশন করা হয়। সূত্র জানায়, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে এলএইচএফ ফুড, সাতমসজিদ রোডে ঝাল লাউঞ্জ, এইচটুও, অ্যারাবিয়ান নাইটস, ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডে লাউঞ্জ সিক্স, সেভেন টুয়েলভ, ফুড কিংসহ ১০টি সিসা বার এবং উত্তরা এলাকায় ৪ নম্বর সেক্টরে হাঙরি আই-১, হাঙরি আই-২, উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ক্যাফে মিররসহ ১২টি সিসা বার রয়েছে।

জানতে চাইলে ডিএনসির সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) মেহেদী হাসান বলেন, ‘রিট করার কারণে উপাদান পরীক্ষা ছাড়া আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে খবর পেলে অভিযান চালাই। এক মাস আগে প্লাটিনাম স্যুট নামে একটি লাউঞ্জ থেকে উপাদান নিয়ে পরীক্ষা করে বেশি নিকোটিন পেয়েছি। সেটি বন্ধ আছে।

তিনি বলেন, আমরা আমাদের নজরদারি রেখেছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থাও নিচ্ছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads