• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

অবৈধ স্বর্ণের গন্তব্য ভারত!

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০২১

ডাকাতির স্বর্ণ কয়েক হাত ঘুরে চলে যায় পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে। সেখানে স্বর্ণালঙ্কার গলিয়ে আকার দেওয়া হয় বিস্কুটের। পরে আরো কয়েক হাত ঘুরে সেইসব সোনার বিস্কুট চলে যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। দিনের পর দিন এভাবেই ডাকাতির স্বর্ণালঙ্কার পাচার হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশের বেশ কয়েকটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি এবং গ্রেপ্তারকৃত স্বর্ণ চোরাকারবারিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে এসব তথ্য। অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পাচারকারীদের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন জড়িত থাকে। ফলে অনেক কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করলেও তারা কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পুনরায় আগের পেশায় ফিরে যাচ্ছে।

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের এক কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে স্বর্ণের মূল্য কম থাকায় বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পাচারকারী চক্র। এসব স্বর্ণ শুধু ভারতেই পাচার হয় না, রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ কিছু এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্বর্ণের বার সংগ্রহ করছে। এই চক্র দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণ পাচারের পর সড়কপথে ভারতে পাচার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বেশ কয়েকটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটননায় গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কয়েকজনকে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ সদরের চিতলিয়া বাজারে স্বর্ণের দোকানে শতাধিক ভরি স্বর্ণ ডাকাতির ঘটনায় লুটকৃত স্বর্ণ রাজধানীর তাঁতীবাজারের শরিয়তপুর গোল্ড হাউস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৬ সেপ্টেম্বর আশুলিয়ার নয়ারহাট বাজারস্থ ১৯টি স্বর্ণের দোকানে ১ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার টাকার মালামাল ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় এক দম্পতিসহ ডাকাতি ও ডাকাতির স্বর্ণ ক্রয়ের সাথে জড়িত ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এসব স্বর্ণ পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে বেচাকেনার তথ্য পায় সিআইডি। তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, দেশের বিভিন্ন স্থানে লুণ্ঠিত স্বর্ণের অলংকার গলিয়ে স্বর্ণের পাত বানিয়ে তাঁতীবাজারে অবৈধ ব্যবসা করছে কিছু ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত সবুজ রায় ও আ. রহিম স্বীকার করে তাঁতীবাজারের খাঁজা করপোরেশন, রাজিয়া বুলিয়ান স্টোর, সুমন বুলিয়ান স্টোর চোরাই ও ডাকাতির স্বর্ণ কেনবেচার সাথে জড়িত।

এর আগে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ধানমন্ডি থানাধীন রাপা প্লাজার রাজলক্ষ্মী জুয়েলার্সে তালা ভেঙে ৫০০ ভরি স্বর্ণ লুট করে। এ ঘটনার সাথেও জড়িত ছিল আ. রহিম (৩১)। এ ঘটনায় তাকেসহ গ্রেপ্তার করা হয় কয়েকজনকে।

আশুলিয়ায় ডাকাতির ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তাধর সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লাসহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ডাকাতি করা স্বর্ণ তাঁতীবাজারে ঢুকে হয়ে যায় বৈধ। মুক্তাধর বলেন, লুট করা স্বর্ণালঙ্কার রাজধানীর তাঁতীবাজারে অবৈধভাবে বেচাকেনার সুস্পষ্ট তথ্য রয়েছে সিআইডি’র কাছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে লুণ্ঠিত স্বর্ণের অলঙ্কার গলিয়ে স্বর্ণের পাত বানিয়ে মূলত তাঁতীবাজারে অবৈধ ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকায় কিছু স্পট ও জুয়েলারির দোকানে অবাধে চোরাই স্বর্ণ বেচাকেনা হয়। এসব স্বর্ণের প্রধান ক্রেতা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জুয়েলারির ব্যবসায়ীরা। বাকি স্বর্ণের বার বা অলংকার আকারে ভারতে পাচার করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ ডাকাতি কিংবা চোরাচালানের পর গ্রেপ্তারকৃতদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে বেশ কিছু শীর্ষ স্বর্ণ চোরকারবারির নাম। আর এসব সিন্ডিকেট অধিকাংশের সাথেই তাঁতীবাজারের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতার পাওয়া যায়। এরকমই একটি চক্রের অন্যতম হোত পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের তাপস মালাকার ও তার স্ত্রী মন্টি মালাকার। গত বছরের ২৫ আগস্ট র্যাব-১ এর একটি দল সাভার থেকে এই দম্পতি ও তাদের সহযোগী দুল্লাল চন্দ্র্র দাসকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের অন্তর সিলভার স্টোরের কর্ণধার দ্বীনবন্ধু সরকার নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য হতে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিমান পথে স্বর্ণের বার ও অলঙ্কার আকারে দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণ নিয়ে আসে। এরপর এসব স্বর্ণের অলঙ্কারগুলো দেশে বিভিন্ন স্থানে গলিয়ে স্বর্ণের বারের বিভিন্ন আকারের রূপ দিত। এরপর তারা বিভিন্ন মাধ্যমে স্বর্ণের বারগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করত। তাঁতীবাজারে আন্তজার্তিক স্বর্ণ চোরাচালানের আরেক হোতা হচ্ছে শ্যাম ঘোষ। ২০১৮ সালের ১০ জুন তাঁতীবাজার থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি।

২০১৯সালের ২৭ মে ১০৩টি স্বর্ণের বারসহ আব্দুস সালাম নামে এক স্বর্ণ পাচারকারীকে গ্রেপ্তারের পর তিনি জানান, ঢাকার তাঁতীবাজারের জনৈক শ্যাম ও কৃষ্ণা নামে দুই ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে চোরাই স্বর্ণ কিনত। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানের আরেক গডফাদার এইচ এম শামসুল হুদা। ২০১৮ সালে তাকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায় ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক চোরাকারবারিদের নিয়ে একটি আর্ন্তজাতিক সিন্ডিকেট তৈরি করেন তিনি। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ভারতের স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সদস্য অজিত, পারুল, ইউকিল ও কৃষ্টি শর্মার। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত কমপক্ষে ৪২ চোরাকারবারির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন হুদা।

লিটন নামে আরেক স্বর্ণ চোরকারবারিকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, তাদের চক্রটি তাঁতীবাজার থেকে স্বর্ণ ভারতে পাচার করত। লিটন নিজেই কলকাতার সোনাপট্টির জনৈক খলিলের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাকারবারি শুরু করে। তাঁতীবাজারের অলি, শাহাজাহান ও মিলনের কাছ থেকে স্বর্ণ কিনে ভারতে পাচার করতেন তিনি। গত বছরের ২৩ আগস্ট স্বর্ণ নিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে রাজধানীর বিজয়নগরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।

গায়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কলকাতার সন্ধ্যা জুয়েলার্সের মালিক হেমেন্ত কুলি ও বাংলাদেশের জনৈক সুমন যৌথভাবে ডাকাতি ও চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা করছেন। কলকাতার বটতলায় ২৮ নম্বর সন্ধ্যা জুয়েলার্সের মালিক হেমেন্ত কুলির কাছে বাংলাদেশ থেকে ডাকাতি ও লুটকৃত সোনা গালিয়ে বার, বিস্কুট ও খামির করে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে সুমন। গত ১ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরায় বিজিবির অভিযানে বিপুল পরিমাণ লুটকৃত স্বর্ণসহ এক নারী গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা পুলিশের আরেকটি সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রায় অর্ধশত দোকান চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা স্বর্ণ চোরাইচক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। এসব দোকান পল্টন, বায়তুল মোকাররম মার্কেট, মিরপুর-১০ নম্বর, শাহ আলী, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেট, উত্তরা নর্থ টাওয়ার, শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারসহ পুরান ঢাকায় অবস্থিত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads