• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

প্রতারণার ফাঁদে নিঃস্ব শত পরিবার

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি ২০২২

রাজবাড়ী পাংশার মেরাজুল ইসলাম। রাজধানীর শ্যামলীতে ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার শ্যালকের জন্য সেনাবাহিনীর মেস ওয়েটার পদে চাকরির জন্য পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেন হারুন নামের ব্যক্তির কছে।

মেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শ্যালকের চাকরির জন্য গত অক্টোবরে ইউসিবি ব্যাংকে হারুনের অ্যাকাউন্টে টাকা দেই। একমাস পর একটা নিয়োগপত্র দেয় সে। আমার শ্যালককে ক্যান্টনমেন্টের পাশের একটি বাসায় নিয়ে রাখা হয়। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি বিয়েতে একদিন ডিউটিও করে। এরপর ১৫ দিন তাকে বসিয়ে রাখে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও নেয় না। তখন আমরা বুঝতে পারি সে প্রতারণার শিকার। এরপর আমি আমার শ্যালককে নিয়ে আসি। হারুনের কাছে টাকা ফেরত চাই। কিন্তু তার কোনো হদিস পাচ্ছিলাম না।

একইভাবে প্রতারণার শিকার বগুড়ার শিবগঞ্জের আলমগীর হোসেন রতন। মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে। জামাইকে খাদ্য অধিদপ্তরে উপ-পরিদর্শক পদে সরকারি চাকরি দেবেন বলে সেই হারুনকেই তিন লাখ টাকা দেন। মেয়ের জামাইয়ের চাকরিতো হয়ইনি উল্টো মেয়ের সংসার ভাঙার উপক্রম। মেরাজুল রতনের মতো এ রকম আরো কয়েকশ জন রয়েছেন, যারা হারুনকে সরকারি চাকরির জন্য টাকা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। পাশাপাশি প্রায় করে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

পরিচিত মানুষজনের কাছে নিজেকে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে উপস্থাপন করতেন হারুণ। বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে তার সখ্যতা রয়েছে বলে চাকরিপ্রার্থীদের কাছে বলতেন তিনি। এভাবে পরিচয় দিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সহজ সরল মানুষের টাকা আত্মসাৎ করতেন হারুন।

সিআইডি হারুণ ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে। হারুনকে কেরানীগঞ্জ থেকে এবং অপর দুজনকে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হারুনের (৩৬) বাড়ি নওগাঁর বদলগাছি এলাকায়। তার দুই সহযোগী হলেন মাসুদ রানা (২৩) ও সেকান্দার আলী (৩৪)।

গতকাল সোমবার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন এসব তথ্য জানান।

ইমাম হোসন বলেন, ‌‘পল্টন থানায় একটি মামলার ভিত্তিতে হারুন অর রশীদ ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা চাকরি দেওয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছে।’

অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তারা জাল নিয়োগপত্র দিতেন। বিভিন্ন মন্ত্রীর ভুয়া ডিও লেটারও তৈরি করেছেন। চক্রের মূল হোতা হারুন অর রশীদ। তাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা আরো অভিযোগ পাচ্ছি।

ভুক্তোভোগী রতন বলেন, ‘আমার খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমে হারুনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। হারুণ মাঝে-মাঝে ফোন দিত। খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে জানাতো। আমার মেয়ের কয়েক মাস আগে বিয়ে হয়েছে। জামাই চাকরি খুচ্ছিল। হারুণ আমাকে জানালো, সে খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরি দিয়ে দিতে পারবে। মেয়ের শ্বশুরের সঙ্গে আলাপ করি। ৩০ লাখ টাকায় খাদ্য উপপরিদর্শক পদে চাকরির বিষয়ে হারুণের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। মেয়ের শ্বশুর বলেন, চাকরি হলে টাকা দেবেন। আমরা শুরুতে তিন লাখ টাকা দেই হারুণকে। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টে আমার মেয়ে জামাইয়ের নাম আসেনি। বিষয়টি হারুনকে জানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে আর ফোন ধরে না। এভাবে ঘোরাতে থাকে। টাকা ফেরত দেয়নি।

একইবাবে কেউ সৌদির ভিসার জন্য টাকা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, আবার কেউ সেনাবাহিনীতে চাকরি পেতে হারুণকে টাকা দিতে সুদে টাকা এনেছেন। সিআইডি কার্যালয়ে এ রকম ৫-৬ জন ভুক্তোভোগীকে পাওয়া গেছে, যারা হারুনকে বড়মাপের প্রতারক বলেছেন।

সিআইডির কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বলেন, ‌‘হারুন জাল জালিয়াতি করে মানুষের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতো। তার কাছ থেকে বিভিন্ন জাল নিয়োগপত্র, স্ট্যাম্প, ব্ল্যাঙ্ক চেক উদ্ধার করা হয়েছে।’

সিআইডি জানায়, হারুনের এই চক্রে ১০-১২ জন রয়েছে। সম্প্রতি হারুন সারা দেশেই দালাল নিয়োগ করে আনুমানিক কয়েকশজনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। সেই হিসেবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছে সে।

সূত্র জানায়, হারুন একটি ভুয়া হজ অ্যাজেন্সির পরিচালক বলে পরিচয় দিতেন। যখন কোনো এলাকায় যেতেন দামি কোনো জিপ ভাড়া করে যেতেন। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ ও গরিব অসহায় মানুষকে কিছু টাকাও দিতেন। এতে করে লোকজন তার ওপর বিশ্বাস আনতো।

আর এই বিশ্বাসকে পুঁজি করেই প্রতারণার ফাঁদ পাততো। মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে গ্রামের সহজ সরল মানুষদের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করে আসতো। চাকরির জন্য যারা তার কাছে আসতো প্রথমে তাদের নিকট থেকে অগ্রিম হিসেবে টাকা নিত। এরপর বিশ্বাস ধরানোর জন্য ফাঁকা চেক ও ব্ল্যাঙ্ক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে রাখতো। টাকা নেওয়ার পর কখনো চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র দিতো আবারো কখনো সে আর ফোন ধরতো না।

এভাবে কিছুদিন গেলেই চাকরি প্রার্থীরা প্রতারণার শিকার হয়েছে জেনে ওইভাবে কেউ আর যোগাযোগ করতো না।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, হারুন ও তারসহযোগীরা প্রতারণা করে আনুমানিক ৫০ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে। গ্রেপ্তারের খবর পাওয়ার পর তার দ্বারা প্রতারণার শিকার অনেকে এখন যোগাযোগও করছে।   

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads