• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

প্রথম পৃষ্ঠা

রংপুরে আইনজীবী রথীশ হত্যা

কামরুলের পরিকল্পনাতেই খুন করা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৭ এপ্রিল ২০১৮

রংপুরে চাঞ্চল্যকর আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিকের প্রেমিক কামরুল ইসলাম। তার পরিকল্পনাতেই ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাত-পা বেঁধে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় আইনজীবী রথীশকে।

পুলিশ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় প্রেমিক কামরুল ইসলামকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। আর রথীশের স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক ও তাদের দুই ছাত্র রোকন ও সবুজ পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্নিগ্ধা সরকার জানিয়েছেন, পারিবারিক কলহ, অবিশ্বাস, অশান্তি, রথীশের বাসায় সময় ও খরচের টাকা না দেওয়া এবং একাকিত্ব থেকেই সহকর্মী কামরুলের প্রতি পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি।

পুলিশের সূত্রটি আরো জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে রথীশ ও তার স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক এতটাই খারাপ ছিল যে এক ঘরে একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে কথা হতো না দীর্ঘদিন। রথীশ চন্দ্র বাসায় বাজার খরচ বা স্ত্রীর হাতখরচের টাকাও দিতেন না। রথীশ চন্দ্র ভৌমিক সরকারপক্ষের পিপি এবং প্রভাবশালী আইনজীবী ছাড়াও ব্যক্তিগত অনেক সম্পত্তি ও টাকাপয়সা ছিল তার। কিন্তু সেই সম্পত্তি ও টাকাপয়সার কোনো খোঁজই ছিল না স্নিগ্ধার কাছে। টাকার প্রয়োজন হলেও স্ত্রীকে দিতেন না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে রথীশের মানিব্যাগ থেকে টাকা সরিয়ে রাখতেন স্নিগ্ধা। সেই টাকা থেকে প্রয়োজন মেটাতেন। স্কুল থেকে যে বেতন পেতেন সেই টাকা ছেলে-মেয়েকে দিয়ে দিতেন।

পুলিশ জানায়, স্বামী-স্ত্রীর এসব ঘটনায় পরিবারে সব সময় অশান্তি লেগে থাকত। একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে বিষয়টি নিয়ে সহকর্মী কামরুলের সঙ্গে আলোচনা করতেন দীপা। সুযোগ নিয়ে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে কামরুল ইসলাম। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

পুলিশের সূত্রটি জানায়, মূলত বছরখানেক আগেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়। যা দৈহিক সম্পর্কে গড়ায়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে কামরুল ইসলাম প্রায়ই প্রেমিকা স্নিগ্ধার বাসায় রাত কাটাতেন। একপর্যায়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কামরুল ইসলাম স্নিগ্ধা সরকার দীপাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব স্নিগ্ধা সরকার নাকচ করায় পরকীয়া চালিয়ে যান তারা। তাদের ঘনিষ্ঠতা এমন অবস্থায় চলে গিয়েছিল যে, একপর্যায়ে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। তাই পথের কাঁটা সরাতে মাসখানেক আগেই রথীশকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কামরুল ও দীপা ভৌমিক।

যেভাবে খুন হন রথীশ : ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার। আদালত শেষ করে বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছিল রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের। আর আগে থেকেই বাসায় অবস্থান নেন প্রেমিক কামরুল ইসলাম। ওইদিন সন্ধ্যার পর স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক বার বার রথীশ চন্দ্রের মোবাইলে কল করছিলেন। যাতে বাসায় দ্রুত আসেন তিনি। রাত ১০টার দিকে বাসায় এলে ফ্রেশ হয়ে একটি নীল রঙের গেঞ্জি পরেছিলেন রথীশ। পরে খাবার টেবিলে যান। আগে থেকে প্রস্তুত করা খাবারের মধ্যে ডালে পাঁচটি ও দুধে পাঁচটি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে রাখা হয়। একইভাবে মেয়েকেও খাবারের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে রথীশ চন্দ্র ঘুমিয়ে পড়লে কামরুলের নির্দেশেই হাত-পা বাঁধেন স্নিগ্ধা সরকার। এরপর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে বাসায় থাকা একটি নীল রঙের আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখা হয় মরদেহ। হত্যার পর ওই বাসায় রাত কাটান কামরুল। পরদিন ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে আবার সকাল ৮টা অথবা সাড়ে ৮টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে রথীশের বাড়িতে আসেন কামরুল। খুব স্বাভাবিকভাবে বাড়ির বাইরে তেঁতুলগাছের নিচে তার মোটরসাইকেলটি রাখেন এবং একটি ভ্যান ডাকেন। ভ্যানটি বাসার সামনে নিয়ে কামরুল, স্নিগ্ধা, ভ্যানচালক ও রাস্তা থেকে একজনকে ডেকে আলমারিটি ভ্যানে তোলা হয়। সেখান থেকে ভ্যান নেওয়া হয় মোল্লাপাড়ায় কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন বাড়িতে। ভ্যানচালক কামরুলের নির্দেশেই আলমারিটি সেখানে রেখে চলে আসেন।

পুলিশ জানায়, কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন ওই বাড়িতে আগে থেকে তাদের দুই ছাত্র রোকন ও সবুজকে দিয়ে একটি গর্ত খুঁড়িয়ে রাখা হয়। ছাত্রদের পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয় প্রতিজনকে ৩০০ টাকা। তারা গর্ত খুঁড়েই চলে যায়। এরপর কামরুল আলমারি থেকে লাশ নামিয়ে মাটিতে পুঁতে রেখে কিছু বালু দিয়ে ঢেকে রাখেন। এরপর আবার ওই দুই ছাত্রকে ডেকে ওই বালুর উপরই মাটি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়। তবে সেখানে কী হয়েছে ওই ছাত্ররা তা কিছুই জানত না। পুলিশ ওই দুই ছাত্রকেও আটক করেছে। পরে তাদের গ্রেফতারও দেখানো হয়েছে।

এদিকে রথীশ চন্দ্রের স্ত্রী স্নিগ্ধার পরকীয়ার পুরো বিষয়টি জানত রথীশের ব্যক্তিগত গাড়িচালক মিলন মোহন্ত। পুরো বিষয়টি তার জানা ছিল। এ কারণেই তাকেও মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

পুলিশের বক্তব্য : রথীশ চন্দ্র ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি বাবুল মিয়া বলেন, এ ঘটনায় স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক, তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম, রশীথ চন্দ্রের ব্যক্তিগত সহকারী ও গাড়িচালক মিলন মোহন্ত এবং দুই ছাত্র রোকন ও সবুজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কামরুল ইসলামকে ১০ দিনের রিমান্ড ও স্নিগ্ধা সরকার দীপা এবং রোকন ও সবুজ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads