• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
তবুও তারা আস্থায় নেই

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

সংগৃহীত ছবি

সরকার

তবুও তারা আস্থায় নেই

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ০৩ অক্টোবর ২০১৮

·     চার ও ছয় মাসের মাথায় চার ডিসি পদ হারান

·     দুদিনে আরো ২০ ডিসি বদলি

চলতি বছরের ৩ মে গাইবান্ধা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ হোসেনকে জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) করা হয়। চার মাসের মধ্যেই গত ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক অতুল চন্দ্র সরকারকে জয়পুরহাটের ডিসি পদে নিয়োগ দেয় সরকার। একইভাবে গত ৩ মে জামালপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মেহেরপুরের ডিসি পদে নিয়োগ পান। তাকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সরিয়ে মেহেরপুরে ডিসি করা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংযুক্ত উপসচিব আতাউল গনিকে।

শুধু এরাই নন, গত ২৩ ও ২৭ সেপ্টেম্বর দুদিনে ৬৪ জেলার মধ্যে ২০টির ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়। একইভাবে পুলিশ সুপার (এসপি) পদেও কিছু রদবদল হয়েছে। আরো কিছু জেলায় ডিসি ও এসপি পদে পরিবর্তন আনা হতে পারে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রতিনিয়তই বদলি হচ্ছেন। এ ছাড়া সচিব পদেও বেশ কিছু রদবদল হয়েছে। পাশাপাশি গত সোমবার সিনিয়র সহকারী জজ, সহকারী জজ, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার ২৭৪ জন বিচারককে বদলি করা হয়েছে। হঠাৎ করে বিচার বিভাগের এত কর্মকর্তাকে একযোগে সরানো নিয়ে জনমনে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই সময়ে মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে তারা নিজেদের লোক বসিয়েছে। তবু নির্বাচনের প্রাক্কালে ডিসি, এসপি এবং ইউএনও পদে এত রদবদল কেন? তাহলে কি সরকার নিজেদের লোকের ওপরই আস্থা রাখতে পারছে না? নাকি তারা কোনো অনিয়মে জড়িত? বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বদলি হওয়া কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসনে ঠিকঠাক কাজ করতে পারছিলেন না। তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগও ছিল। কিছু কিছু জেলায় কাজকর্ম থমকে গিয়েছিল। ফলে নিজেদের লোক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিশ্বাস করতে পারছে না সরকার।

জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) এনএম জিয়াউল আলম গতকাল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সরকারের ইচ্ছায় কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। এখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা মানেই বদলিযোগ্য। কাজেই এখানে ভিন্ন কিছু খোঁজা উচিত নয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সিলেটে নুমেরি জামান এবং ঠাকুরগাঁওয়ে মো. আখতারুজ্জামান ডিসি হিসেবে পদায়ন পেলেও ছয় মাসের মাথায় তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। অপেক্ষাকৃত তরুণ এই দুই কর্মকর্তাকে বদলি করা নিয়ে প্রশাসনে কানাঘুষা চলছে। তবে কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেছেন, সিলেটের মতো জায়গায় তরুণ একজনকে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া ঠিক হয়নি। আমাদের ইউএনও পদে নিয়োগ পেতেই লেগেছিল ১০-১২ বছর। সেখানে এখন ৮-১০ বছরেই একজন ডিসি হয়ে যাচ্ছেন। ফলে তাদের অভিজ্ঞতা কম থাকে। মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন সমস্যা তারা সামাল দিতে পারেন না। এতে সরকার বাধ্য হয়ে তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। তবু তরুণদের ডিসি পদে কেন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যে সবাই তো আর অনভিজ্ঞ নন। তারপরও কিছু কিছু কর্মকর্তা তদবির করে পদ বাগিয়ে নেন। তাদের বেশিরভাগ ‘ধরা’ খান বলে তিনি মনে করেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বেশ আগে থেকেই প্রশাসন সাজাতে শুরু করে সরকার। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশাসনে পছন্দের ব্যক্তিরাই যাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন- এমন চিন্তাভাবনা থেকেই তা করা হচ্ছে। গত নির্বাচনের সময়ও একই কাজ করা হয়েছিল। সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োজিত থাকেন জেলা প্রশাসকরাই। সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা থাকেন সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে। তবে কয়েকটি এলাকায় সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন অফিসারকেও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়ার নজির আছে। আর ভোটকে সামনে রেখেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বদলি করা হচ্ছে। মূলত এটা রুটিন ওয়ার্ক হলেও এটা নির্বাচনী প্রশাসন সাজানোর ছকের অংশ।

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এসব বদলি নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই। সরকার যাকে ভালো মনে করবে তাকেই পদায়ন করবে। এটা সরকারের এখতিয়ার। কিন্তু কেন নিজেদের লোক হয়েও কর্মকর্তারা আস্থা হারান- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে দায়িত্ব নেওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত ও সন্দেহভাজন বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করে। যাদের আর পোস্টিং দেওয়া হয়নি। কয়েকজনকে ডাম্পিং কিংবা হয়রানিমূলক পোস্টিং দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ তালিকার বেশিরভাগ কর্মকর্তার দফায় দফায় পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং না পাওয়ায় প্রশাসনে গত ১০ বছরে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি বিএনপিপন্থি কর্মকর্তারা। আর যারা তদবির করে পোস্টিং নিতে পেরেছেন তারাও ক্ষেত্রবিশেষে ছিলেন কোণঠাসা।

বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন নিয়ে সরকার বিভিন্ন ছক করে। সে অনুযায়ী নিজেদের মতো প্রশাসন সাজায়। নির্বাচনের সময় সিভিল প্রশাসনে ডিসি, ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কর্ণধার থাকেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও এ দায়িত্ব পালন করবেন। ওই সময় ডিসি, এডিসি ও ইউএনও ছাড়াও জেলা প্রশাসনে কর্মরত সব সিনিয়র সহকারী সচিব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পান। এ ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় ম্যাজিস্ট্রেট কম হওয়ায় সচিবালয় থেকে সিনিয়র সহকারী সচিবদের ম্যাজিস্ট্রিয়াল পাওয়ার দিয়ে ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু কাকে কোথায় দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা নির্ভর করে ডিসির ওপর। এ ছাড়া প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ দেন ইউএনও। যাদের একটি বড় অংশ থাকেন শিক্ষক এবং তাদের অধিকাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ জন্য কাকে কোন কেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়া হবে তার ওপরও সূক্ষ্ম ভোট কারচুপির অনেক কিছুই নির্ভর করে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখন প্রশাসন সাজানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads