• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
দূষিত পানি ভীষণ দামি

সংগৃহীত ছবি

মহানগর

১২ বছরে দাম বাড়ানো হয়েছে ১৩ দফা

দূষিত পানি ভীষণ দামি

  • নাজমুল হুসাইন
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০২০

নগরবাসীকে নিরাপদ পানি সরবরাহে অনেকটাই ব্যর্থ ঢাকা ওয়াসা। এর মধ্যে আবার রয়েছে পানির সংকট, শহরের প্রান্ত এলাকাগুলোতে তীব্র সরবরাহ সমস্যা। তারপরও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ে পানির দাম। গত এক যুগে দাম বাড়ানো হয়েছে ১৩ দফা। এতে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে নগরবাসীর মধ্যে।

জনগণের পানি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও ব্যক্তিদের মতে, সেবার মান উন্নয়ন ও নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি জনসাধারণের জন্য প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির অপচয় রোধ না করায় সংস্থাটির (ঢাকা ওয়াসা) ঘাটতি, পরিচালন ব্যয় ও ঋণের বোঝা বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ওয়াসার এ দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য এবং এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা।

অন্যদিকে কয়েকদিন আগে পানির দাম বাড়ানোর খবরে নগরীর বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বহন আরো কঠিন হয়ে পড়বে। কেউ বলছেন, মিটার না দেখেই অনুমাননির্ভর বিল করে আসছে ওয়াসা, এ অবস্থায় নতুন করে দাম বাড়ানো যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

পানির মান ও দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকার গৃহবধূ শারমিন আক্তার বলেন, প্রতিদিন পানির মেশিন ছাড়ার পড়ে ওয়াসার লাইনে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসে। এসব পানির রংও কালচে। কখনো কখনো পানির সঙ্গে পোকামাকড় আসে। এসব সমস্যা ওয়াসা কখনো গায়েই লাগায় না। ইচ্ছেমতো শুধু দাম বাড়িয়ে যায়, যেন মগের মুল্লুক।

এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো প্রতিদিন পানির পাম্প থেকে বা অন্য এলাকা থেকে খাওয়ার পানি আনতে হয় অনেক পরিবারকে। কারণ ওয়াসার পানি সুপেয় নয়। কিছু এলাকায় দুর্গন্ধের কারণে পানি ফুটিয়েও খাওয়া যায় না। আর যারা এমন পানি পান করেন, তাদের অনেকেই পেটের পীড়ায় ভুগেছেন এবং এখনো ভুগছেন। এছাড়া ট্যাপের পানির সঙ্গে আসা ময়লা চোখে গিয়ে চোখের সংক্রমণে ভুগেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কমেনি। এ পরিস্থিতিতে কিছু এলাকায় ফ্ল্যাটের মালিকরা চাঁদা তুলে গভীর নলকূপ বসিয়েছেন। কিন্তু ওয়াসার লাইন থাকায় পানি ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসেই বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। এবার তাদের বিলের অঙ্কটা আরো বেশি হবে।

এদিকে ওয়াসার পানির দুরবস্থা উঠে এসেছিল গত বছরের শেষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশর (টিআইবি) একটি গবেষণায়। তাতে দেখা গিয়েছিল, ঢাকা ওয়াসার অধীনে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ সেবাগ্রহীতা চাহিদা অনুযায়ী পানি পান না। এছাড়া ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতার কাছে সরবরাহ করা পানি অপরিষ্কার এবং ৪১ দশমিক ৪ শতাংশের কাছে সরবরাহ করা পানি দুর্গন্ধযুক্ত। দূষিত পানিই শুধু নয়, গবেষণা বলছে, ওয়াসার সেবার মান ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সার্বিকভাবে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতাই অসন্তুষ্ট। তাই সেবাগ্রহীতাদের মতামত না নিয়ে এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও সিস্টেম লস নিরসনে সুনির্দিষ্ট ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা ছাড়াই একতরফাভাবে পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রাহকের ওপর অন্যায্য বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। এটা সরবরাহকারীর একগুঁয়েমি সিদ্ধান্ত বলে মনে করে টিআইবি।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সেবার মান উন্নত ও পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত না করে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঢাকা ওয়াসার একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ। পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধের অজুহাতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে পানির দাম বাড়ানো অগ্রহণযোগ্য।

যদিও গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গ্রাহক, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মতামত নিতে গণশুনানির ব্যবস্থা রয়েছে; কিন্তু ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভোক্তাদের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পানির ক্ষেত্রেও এমন শুনানি জরুরি। হুট করেই এভাবে পানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পানির দাম বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়। এতে বাড়ি ভাড়া, রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য সেবার মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যা জনগণের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। সরকারের উচিত ছিল কঠোরভাবে নজরদারি করা।

তথ্য বলছে, এমন ব্যবস্থা না থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ওয়াসা। সংস্থাটি গত এক যুগে নগরীতে মোট ১৩ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে পানির দাম প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যান্য সেবার তুলনায় অনেক বেশি। ২০০৯ সালে ঢাকায় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। দাম বাড়ানোর কারণে আগামী এপ্রিল থেকে তা হচ্ছে ২০ টাকা।

এদিকে সংস্থাটি পানির দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন করে যাচ্ছে প্রায়ই। ওয়াসারই আইনে রয়েছে, ‘ওয়াসার বোর্ড প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে।’ কিন্তু এবার পানির দাম ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আবার বছরে একবার দাম বাড়ানোর এখতিয়ার থাকলেও ২০১৬ সালে দাম বেড়েছিল দুবার।

এ প্রসঙ্গে ওয়াসার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমানে যে হারে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। এমনকি এশিয়ার বিভিন্ন বড় শহরের তুলনায় সবচেয়ে কম দামে ঢাকা ওয়াসা পানি বিক্রি করছে বলে দাবি করে সংস্থাটি। উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য করা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের সুদ এবং আসলের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়ে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার তিনটি পানি শোধনাগার এবং ৯৩০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। তবে গভীর নলকূপ চালু রয়েছে ৮৭০টি। বর্তমানে ওয়াসার পানি উৎপাদনক্ষমতা ২৬০ কোটি লিটার। আর চাহিদা রয়েছে ২৩৫ কোটি থেকে ২৪০ কোটি লিটার। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও রাজধানীর ৩ লাখ ৭৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে বেশির ভাগই পানির মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন।

অন্যদিকে ওয়াসার লোকসানের একটি বড় কারণ পানির অপচয়। ঢাকা ওয়াসার দৈনিক উত্তোলিত পানির মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ অপচয় হয় দীর্ঘদিন ধরেই। ওয়াসার গাফিলতি, কারিগরি ত্রুটি, অবৈধ সংযোগ, বৈধ গ্রাহকদের ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে প্রধান লাইন থেকে পানি টেনে নেওয়া, অযথা ও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার, ট্যাংক ভরে যাওয়ার পরও মোটর বন্ধ না করা, অযথা কল খুলে রাখাসহ অনেকভাবে এই অপচয় হয়। এই অপচয়ের জন্য দায়ী সংস্থাটির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লাভের জন্য এই অপচয়ে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads