• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
রাজধানীবাসীকে তাড়া করছে ডেঙ্গুর ভয়

প্রতীকী ছবি

মহানগর

রাজধানীবাসীকে তাড়া করছে ডেঙ্গুর ভয়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৯ মার্চ ২০২০

ঢাকায় বেড়েছে মশার উপদ্রব। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সর্বত্রই মশার দখলে। মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় নগরবাসীকে তাড়া করছে ডেঙ্গুর ভয়। মশক নিধনে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এবার গেল মৌসুমের ভয়াবহতা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ঢাকায় যে পরিমাণ মশা রয়েছে, শুধু ওষুধ ছিটিয়েই তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

গত মৌসুমে ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সরকারি হিসাবেই ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আক্রান্ত হন কয়েক লাখ মানুষ। ডেঙ্গু রোধে ওই সময় ব্যাপক তৎপরতা চালায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও সমালোচনার ঝড় ওঠে। ডেঙ্গু ভয়াবহতার মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে হয় উচ্চ আদালতকেও। এরপর ঢাকা সিটি নির্বাচন ঘিরে গত জানুয়ারি থেকেই মশক নিধন কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দেয়। এর ফলে রাজধানীজুড়েই মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। চলতি মাসে সেই উপদ্রব এখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় নগরবাসী দিন পার করছেন গত মৌসুমের ভয়াবহতা ভেবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে রাজধানীর সড়ক, খাল, জলাধার থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতে মশার যন্ত্রণায় বিরক্ত নাগরিকরা। সমস্যা সমাধানে একাধিক আশ্বাস ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষের সেবার ফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ ঢাকাবাসীর। অপরদিকে করপোরেশন বলছে, সবার সম্পৃক্ততা ছাড়া কেবল সিটি করপোরেশনের পক্ষে মশক নিধন কঠিন।

ডেঙ্গু সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের উদ্যোগ ও ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির পক্ষ থেকে এলাকাভিত্তিক মশক নিধন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি পরিচালনা করা হয় বিশেষ অভিযান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধ্বংস করা হয় মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল। এ সময় ডেঙ্গু উপদ্রব অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে।

রাজধানীবাসীর অভিযোগ, গোটা নগরজুড়েই মশার উপদ্রব সহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্য  ঢলে  পড়তেই ঘরে-বাইরে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ট তারা। আর মশক দমনে করপোরেশনের কার্যক্রমকে ‘নামমাত্র’ আখ্যা দিয়েছেন কেউ কেউ।

সমপ্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে নগরের মশক ঝুকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর নাম উঠে আসে। জরিপ অনুযায়ী, দুই সিটির মোট ১১টি ওয়ার্ড মশক ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটির ৫টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ৬টি ওয়ার্ডের নাম উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, উত্তর সিটির ১, ১২, ১৬, ২০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড মশক ঝুঁকিতে রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে দক্ষিণের ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ এবং ৪২ নম্বর ওয়ার্ড।

রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা কাওছার হাওলাদারের মতে, মশক নিধনে সিটি করপোরেশনকে আরও যুগোপযোগী হতে হবে। তিনি বলেন, আদাবর এলাকায় খাল আছে, সেখানে মশা হয়। খাল বছরে একবার পরিষ্কার করা হয়। এটি কোনো কাজে আসে না। এই একটা খালের জন্য এই পুরো এলাকার মানুষ সারা বছর ভোগান্তিতে থাকে। এ ছাড়া যেখানে খাল নাই, সেখানেও মশা। আসলে মশা মারার পদ্ধতি হয়তো ঠিক নেই। আমার মতে, এবিষয়টা নিয়ে আরও একটু ভাবা দরকার।

একই মত ব্যাংক কর্মকর্তা তাবাসসুম আক্তারের। তিনি বলেন, রাতে ঘুমাতে গেলে মশার কয়েল বা অ্যারোসল ব্যবহার করতেই হচ্ছে। তাহলে আমি সিটি করপোরেশনকে কিসের ট্যাক্স দিব?

রাজধানীরর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মশা জন্মের অন্তত অর্ধশতাধিক জায়গা শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে কিউলেক্স মশা জন্ম নিচ্ছে পয়ঃনিষ্কাশন খালে। আবার বেশির ভাগ খাল পড়েছে উত্তর সিটিতে।

সিটি করপোরেশন বলছে, খালের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নয়। বেশির ভাগ খালের মালিক ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু মশক নিধনের দায় সিটি করপোরেশনের। তাই ওয়াসা বা অন্যান্য সংস্থা খাল পরিষ্কার না করলেও সিটি করপোরেশনকে মশক নিধন করতে হয়।

উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশির ভাগ খালই সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন নয়। আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছি, আন্তমন্ত্রণালয় মিটিংয়ে আমরা বলেছি। তারা আমাকে কথা দিচ্ছে, কিন্তু তারা কাজ করছে না। তারপরও আমরা ১৮০০ বিঘা খালের মধ্যে প্রায় ১২০০ বিঘা পরিষ্কার করেছি। এটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। তবে যে যারটা করলে কিন্তু সময় সাপেক্ষ হতো না। কারও বাজেটের ওপর চাপ পড়ত না।’

কামরাঙ্গীরচর খাল, হাজারীবাগ খালসহ বেশ কয়েকটি খাল রয়েছে দক্ষিণ সিটিতেও। ঢাকা ওয়াসার পরিচালকের সঙ্গে এক সভায় বসে দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ওয়াসা খালগুলো পরিষ্কার করবে।

দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার আমরা একটা মিটিং করেছি। সেখানে ওয়াসার চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা খাল পরিষ্কার করবে। কিউলেক্স মশার জন্য খালগুলো, জলাশয়গুলো দায়ী। সবাই ভাবে, এটা সিটি করপোরেশনের সমস্যা। কিন্তু সবাই যদি মনে করে, এটা আমাদের সবার সমস্যা। তাহলে এটা সমাধান হবে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, খাল ও জলাধার ছাড়াও নগরের বস্তি, রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়, ঝোপঝাড়, টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা মোটর যান মশা জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। এ ছাড়া ঢালাই মেশিন, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পলিথিন, কর্কসিট, বিভিন্ন মার্কেটের পরিত্যক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝের পেসেজে বৃষ্টির পানি ও ভবনের টাঙ্কির পানি জমে সেখানে মশা জন্মাচ্ছে।

নির্মাণাধীন ভবনে ঠিকাদার ও বাড়ির মালিকদের অসচেতনায় সেখানে জন্ম নিচ্ছে এডিস ও কিউলেক্স উভয় ধরনের মশা। এসব মশা নিধনে সিটি করপোরেশন কত কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কের পাশে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এসব পানিতে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের মশা। কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের রাস্তা, বাংলামোটর মোড়, গাবতলী, সায়েদাবাদ এর মধ্যে অন্যতম।

মারুফ হোসেন নামের এক পথচারী বলেন, রাস্তার পাশে মশা জন্মাচ্ছে। সেটা কেউ দেখে না। মশার উপদ্রব কতটা বেড়েছে পাবলিক বাসে উঠলে বোঝা যায়। এত মানুষের মধ্যেও বাসে মশা কামড়াচ্ছে। সিটি করপোরেশন কি কাজ করে? তাদের জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা দরকার।

উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতে, মশক প্রজনন সক্ষম স্থান ধ্বংসে নির্মাণাধীন ভবন মালিক ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো সাড়া দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘মশা নিধনে আমরা কাজ করছি। মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে কাজ করছি, টায়ারের দোকান, নির্মাণাধীন ভবনগুলোকে আমরা নক করছি। কিন্তু সাড়া পাচ্ছি না। আমাদের নব নির্বাচিত মেয়রের নির্দেশনা অনুযায়ী, আমরা যদি তাদের থেকে সাড়া না পাই, তাহলে জনস্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদের মতে, ঢাকার মশার ক্ষেত্রের তুলনায় তাদের জনবল ও সক্ষমতা অপ্রতুল। মশক নিধন শূন্যের কোঠায় না নেয়া গেলেও, সকলের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।

তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মশার ক্ষেত্র, ওষুধ  দিয়ে তা শূন্যের কোঠায় নেয়া সম্ভব না। নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ক্রাশ প্রোগ্রাম হচ্ছে, এটা চলমান কার্যক্রম। মশাকে আমরা একটা লেভেলে রাখার চেষ্টা করব। ঢাকা শহরের মানুষ এবং এলাকার তুলনায় আমাদের সক্ষমতা অপ্রতুল। সেজন্য বারবার আমরা একটা কথা বলছি, নগরবাসীকে সম্পৃক্ত হতে হবে। নিজের বাড়ি-অফিস-ব্যবসা প্রতিষ্ঠাননের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটা যদি তারা ঠিক রাখে, তাহলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads