• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯
ধুলায় ধূসর রাজধানী

ছবি : সংগৃহীত

মহানগর

ধুলায় ধূসর রাজধানী

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০২০

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অফিস করেন রুহুল আমিন। একটি করপোরেট কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি। তার বাসা সিদ্ধেশ্বরীতে। বেসরকারি কোম্পানির গণপরিবহনে প্রগতি সরণি হয়ে প্রতিদিন অফিসে আসেন তিনি। ফেরার পথে অফিস তাকে গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দেয়।

ইদানীং এ পথে বিস্তর ধুলা ও যানজট তাকে বিমর্ষ করে তোলে। মাটির নিচ দিয়ে তার (ক্যাবল) নেওয়ার কাজের খাতিরে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি এই ধুলা ও যানজটের কারণ।

রুহুল আমিন বলেন, দেশে অর্থ খরচের কোনো সমন্বয় নেই। একবার একজন গড়ে তো অন্যজন ভাঙে। রাস্তা গড়তে টাকা লাগে। আবার এ রাস্তা কাটতেও টাকা লাগে। নানা প্রতিষ্ঠান নানা কাজে রাস্তা কাটে। অথচ মসৃণ রাস্তাটি করতে জনগণের কষ্টের অর্থ খরচ হয়েছে।

নানা প্রতিষ্ঠান সমন্বয় করে উন্নয়ন কাজ করলে এমন হতো না বলে মত তার। আর তা না হওয়ার জন্য অপেশাদারি মনোভাব ও সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেন তিনি। রুহুল আমিন বলেন, নভেম্বর মাস শেষ হতে চলল। চারদিক কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু শীতের কুয়াশা না এলেও রাজধানী ঢেকে যাচ্ছে ধুলার চাদরে।

সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে আনারকলি মার্কেটের পাশে খালি জায়গায় একটি ব্যক্তিগত গাড়ি অচল হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন। গাড়িটি ধুলায় ধূসর হয়ে আছে। কিছুদিন আগে এ পথে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি চলে। এরই ফসল এই ধুলা। মজার বিষয়, গাড়িটির গ্লাসে ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা নানাকিছু লিখে রেখেছে। এর একটি ‘আসিয়া+রাহিম’।

এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান সবুজ প্রশ্ন করেন, এমন নাকাল শহরে থাকা যায়? তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘর থেকে বেরোলেই রাজ্যের ধুলা। এত অব্যবস্থাপনা কোনো শহরে নেই। ক্রমেই স্বপ্নের ঢাকা অভিশপ্ত হয়ে পড়ছে বলে মত তার।

পূর্বাচল থেকে প্রগতি সরণি পর্যন্ত জায়গাটিকে কিছুদিন আগেও অনেকে শহরের কাছে ‘মিনি অক্সিজেন’ গ্রাম হিসেবে দেখতেন। ছুটির দিনে সেখানে ঘুরতে যেতেন। এখন সেখানে ধুলার কারণে সামনের রাস্তাও ঠিক করে দেখা যায় না।

স্যাম এনড্রিউ কোস্তা পেশায় একজন এনজিও কর্মী। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার আমার আর স্ত্রীর ছুটির দিন। একটা দিন দুজন একটু ভালো সময় কাটাতেই বাইক নিয়ে চলে যেতাম পূর্বাচল। শেষ যেবার গেলাম, সেদিনের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। ধুলায় মাখামাখি হয়ে ফিরেছি।’

জুরাইন রেলগেট থেকে একটু সামনে এগোলেই পোস্তগোলা ব্রিজ। বামে নারায়ণগঞ্জ সড়ক, ডানে সদর ঘাটের রাস্তা। নির্মাণকাজ চলায় এ রাস্তায়ও ধুলার পরিমাণ বেড়েছে।

জুরাইন থেকে বামে পাগলা-ফতুল্লা মহাসড়কের অবস্থা আরো খারাপ। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বালু তুলে রাখা হয় এ সড়কের যে পাশে নদী আছে সেখানে। সারা দেশে বালু যায় এখান থেকে। ২৪ ঘণ্টা ট্রাকের আনাগোনা। ট্রাকের ধোঁয়া আর বাতাসে বালু উড়ে পুরো রাস্তা ধোঁয়াশার মতো হয়ে আছে।

আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিবেশ অধিদপ্তরের ভবন থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে আগারগাঁও এলাকা। চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। ধুলা যেন না ওড়ে, সে জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। অথচ এ ব্যাপারে নীরব পরিবেশ কর্মকর্তারা। এমনকি যখন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় তখন অধিদপ্তর নাগরিকদের সতর্ক পর্যন্ত করে না। অথচ বায়ুদূষণ কেড়ে নেয় বহু মানুষের প্রাণ।

২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে ওই বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

মিরপুরের কাজীপাড়াতে মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি সোয়ারেজের লাইন ঠিক করতে মাটি খুঁড়ে রেখে গেছে কর্মীরা। দুই পাশে বালি ও মাটির স্তূপ নিয়ে ভ্যানে করে ফুচকা ও স্যুপ বিক্রি করছেন দুজন। পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে আর ধুলোবালিতে একাকার করে দিচ্ছে পুরো এলাকা।

এই পরিবেশে খাবার বিক্রি করছেন প্রশ্নে ফুচকা বিক্রেতা খয়বর আলী বলেন, ‘ধুলাবালু তো মজার জিনিস। কোনো অসুবিধা অয় না।’ পাশে আসবাবপত্রের দোকানি চান মিয়া বলেন, ‘টিভি ক্যামেরায় সাংবাদিকদের এসব বললে ব্যবসা করতে দিব না। ডরাইয়াই থাকতে হয়। এই ধরেন মাসখানেক ধইরা এসব মাটি ফালায় দিয়া রাখছে। কতবার সময় দিছে যে আইসা ঠিক করব। আহে নাই। দেশ এমনেই চলে। গরিবের ধুলাতে কোনো কিছু হয় না।’

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত নির্মাণকাজের নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটার কারণে রাজধানীতে দূষণের মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া নতুন যুক্ত হওয়া মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ নগরে ধুলার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মত দেন নগরবিদরা।

জানা যায়, বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ পরিমাপ করে তৈরি করা বায়ুমান সূচক বা একিউআই অনুযায়ী ঢাকার বাতাসের মান খুবই খারাপ। গত ৮ নভেম্বর ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ১৯০। অথচ স্বাস্থ্যকর মান ৫০। এই ১৯০ আবার সবচেয়ে খারাপ নয়। গত ৫ নভেম্বর এই মান ছিল ৩১৭।

সূচক ৩০০-এর বেশি হয়ে গেলে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি হয় সারা বিশ্বে। অথচ বাংলাদেশে তা হয় না। এর কারণ, বরাদ্দের অভাব।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘করোনায় লকডাউনের সময় ঢাকায় বায়ুর মান ভালো ছিল। এখন গণপরিবহনসহ কলকারখানা, নির্মাণকাজ চালু করে দেওয়ায় কিছুটা খারাপ হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বায়ুমান খারাপ হওয়ার কারণ শুধুই ঢাকা নিজে তৈরি করে না, দেশের বাইরে থেকেও আসে। আমাদের দেশে দিল্লি থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়ে আমাদের দিকে আসে। তাই বেশি ছিল। এখন আবার কমে গেছে। আর কয়েকদিনে আরো কমবে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ১০ পর্যন্ত থাকাটা সহনীয়। তবে অধিদপ্তর বলছে, তারা মান ধরে ৬৫।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুমান সূচক ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে।

জানা যায়, কোনো শহরের বায়ু মানের সূচক ২০০ ছাড়ালে ওই শহরের মানুষকে মাস্ক (মুখোশ) পরার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হয়, সাইকেলে চড়া নিষেধ করা হয়। আর শিশু ও বৃদ্ধদের খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, চীনের বেইজিং শহরে বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পৌঁছে গেলে সেসব দেশের সরকার বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা জারি করে। তবে ঢাকায় এটা কখনো করা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বরাদ্দ না থাকায় শহরে ঘরের বাইরের বায়ুদূষণ নিয়ে তাদের কোনো কার্যক্রম আপাতত নেই।

একটি সংগঠনের আবেদনের পর ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে গত জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নয় দফা নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এর মধ্যে ছিল- খোলা ট্রাকে করে বালু বা মাটি পরিবহন বন্ধ করা, নির্মাণকাজে ঢাকনা ব্যবহার নিশ্চিত করা, নিয়মিত পানি ছিটানো, কালো ধোঁয়া ছাড়লে গাড়ি জব্দ, সড়কের মেগা প্রজেক্টের নির্মাণকাজ ও কার্পেটিংয়ের ক্ষেত্রে আইনকানুন মেনে চলা, অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো, ব্যাটারি রিসাইকিলিং বন্ধ প্রভৃতি।

রিট আবেদনটি করা হয়েছিল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ-এইচআরপিবির পক্ষ থেকে। সংস্থাটির প্রধান মঞ্জুরুল মোরশেদ বলেন, ‘আদালতের আদেশের পর আমরা সক্রিয় ছিলাম, লকডাউনের সময় পরিবেশ ভালো ছিল। এখন আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কর্মী মতিন হায়দার বলেন, ‘দাঁতের ডাক্তারের দাঁতেই পোকা থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তরের হলো সেই অবস্থা।’

উন্নত দেশেও নির্মাণকাজ, যানবাহন চলে, কিন্তু সেসব দেশে দূষণ কম কেন, এই প্রশ্ন তুলে এই পরিবেশ কর্মী বলেন, ‘উন্নত দেশে যেসব শর্ত থাকে আমাদের দেশেও তা থাকে। কিন্তু তারা তা বাস্তবায়ন করে, আমরা শুধুই চিঠি পাঠিয়ে বসে থাকি।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের পরিচালক রুবিনা ফেরদৌসী জানান, গত এক বছরে ৭০০-এর বেশি ইটভাটা বন্ধ করেছেন তারা। গত কয়েক মাসে কালো ধোঁয়া ছাড়ায় ১৯৫টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বাড়ি নির্মাণে নির্দেশনা না মানায় ১৫টি মামলা করে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

কমিটিতে থাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিবেশ সার্কেলের প্রধান প্রকৌশলী তারিক বিন ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের এলাকায় সকল ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা দিয়ে।’ রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটানো হয় না কেন, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে ওপর থেকে তো আদেশ আসতে হবে। আমাদের মেয়র মহোদয় করোনায় আক্রান্ত হলেন। সব মিলিয়ে একটু সময় লাগছে।’

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘এ সময়টাতে বাতাসে সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটারের (সূক্ষ্ম কণা) মাত্রা বেড়ে যায়। তখন কাশি, শ্বাসকষ্ট হয়। ইনফেকশনও হয়।’ তিনি আরো বলেন, বাতাসে সূক্ষ্ম কণার দুই ধরনের মাত্রা থাকে। যদি সূক্ষ্ম কণার মাত্রা ২ দশমিক ৫ হয়ে যায়, তাহলে এটা ফুসফুস পর্যন্ত গিয়ে প্রবেশ করে। আরেকটি মাত্রা যদি ১০ হয়, সেটা শ্বাসনালিতে গিয়ে আক্রমণ করে। এর ফলে অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের সমস্যা বেড়ে যায়। কার্বন-ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে যাওয়ার ফলে ফুসফুসে ক্যানসারও হতে পারে। এ ছাড়া বাতাসে ভাসতে থাকা সিসা শিশুদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। এটা বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সব কটি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান চালানো হচ্ছে। একই সঙ্গে যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী পাওয়া গেলে নিলামে বিক্রি করে দিচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর উন্নয়নকাজে পানি ছিটানোর তদারকি খুব শিগগির শুরু করা হবে।’

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহেদুর রহমান খান বলেন, ‘২.৫ পিপিএমের নিচের যে কোনো ধূলিকণা শ্বাসতন্ত্রে ঢুকে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করে। ফুসফুসকে অকার্যকর করে ফেলে। নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য জটিল ও বিপজ্জনক রোগের সৃষ্টি করে। শীতকাল বা শুকনো মৌসুমে আমাদের দেশে ধূলিদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এর জন্য সবাইকে সাবধানে ও সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করা উচিত। আর ধূলিদূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads