মহামারী করোনার মধ্যে সৌদিআরব ও কুয়েতগামী শ্রমিকদের কোয়ারেন্টিনের খরচ বাঁচাতে সারা দেশের ন্যায় গত শুক্রবার থেকে সিলেটেও শুরু হয়েছে টিকার নিবন্ধন কার্যক্রম। প্রতিদিন ভোর থেকে সিলেট নগরীর উপশহর সি ব্লকের ৪১ নম্বর রোডের জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে নিবন্ধন করতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন প্রবাস যাত্রীরা। কঠোর লকডাউন ও বৃষ্টি মাড়িয়ে দূরদূরান্ত থেকে শতাধিক প্রবাসী জড়ো হয়েছেন এখানে। তবে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন তাদের বেশিরভাগই। সারা দিন অপেক্ষা করেও অনেকে নিবন্ধন করতে পারেননি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রবাসীরা। আবার কোন কোন প্রবাসী দালাল চক্রের হাতে পড়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে নিবন্ধন করে ফিরছেন।
এদিকে, নিবন্ধন করলেও কবে টিকা পাবেন জানেন না প্রবাসীরা। এমনকি বিএমইটি সিলেট কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও বলতে পারছেন না কবে টিকা প্রয়োগ হবে। তারা শুধু তালিকা করে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন।
প্রবাসীদের অভিযোগ, পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে সরকারের তহবিলে ২২০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু তারা কয়েকদফা চেষ্টা করেও টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। বিকাশের অ্যাপসে টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের।
এ ছাড়া সুরক্ষা অ্যাপসে প্রবেশে সমস্যা করছে বলেও জানান তাদের কয়েকজন। এমন সমস্যার কারণে দিনভর কর্মসংস্থান অফিসে বসে থেকেও নিবন্ধন করতে পারেননি অনেক প্রবাসী। অফিসের সামনেই অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বিকাশের বদলে ক্যাশে টাকা জমা নেয়ারও দাবি জানান তারা।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ’ প্রবাসী অফিসের সামনে ভিড় করেছেন। লাইনে না দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে আছেন সবাই। এতে করোনা সংক্রমণেরও ঝুঁকি বাড়ছে। মাঝে মধ্যে সার্ভার ডাউন হয়ে পড়ায় নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়ও ধীরগতি দেখা গেছে।
প্রতিদিন ৪-৫ শতাধিক প্রবাসীর উপস্থিতিতে সেখানে স্বাস্থ্যবিধিও উপেক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া টিকার নিবন্ধনের সুরক্ষা অ্যাপসে প্রবেশে সমস্যা করছে বলেও জানান কয়েকজন। এমন সমস্যার কারণে দিনভর কর্মসংস্থান অফিসে বসেও নিবন্ধন করতে পারেননি অনেকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অফিসের সামনেই অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
এদিকে, বিদেশগামী শ্রমিকদের বোকা বানিয়ে অতিরিক্ত ফি নিয়ে নিবন্ধনের জন্য সুযোগ করে দিতেও দেখা গেছে। নানা অজুহাত দেখিয়ে ২০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে জমা নেয়ার বিপরীতে ৬০০-৮০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। এজন্য বিকাশের বদলে নগদ টাকা জমা নেয়ার দাবি জানিয়ে প্রতিবাদ করেন তারা।
কঠোর লকডাউনের মধ্যে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলা থেকে নিবন্ধন করতে এসে ভোগান্তিতে পড়েছেন সৌদিআরব প্রবাসী জয়নুল আবেদীন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাড়িয়েও বিকাশে টাকা জমা না দেয়ায় নিবন্ধন হচ্ছিলনা তার। ঠিক তখনই দালালের খপ্পড়ে পড়েন সহজ সরল এই রেমিটেন্স যোদ্ধা। নিবন্ধন না হওয়ায় যখন অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ অপরিচিত একজন এসে দরদমাখা কন্ঠে বলে উঠলেন, ভাই আপনি আজ আর জমা দিতে পারবেন না। যদি অতিরিক্ত কিছু টাকা খরচ করতে পারেন, তাহলে স্যারকে রিকুয়েস্ট করে দেখতে পারি। আপনাকে কিছু করতে হবে না, আমার হাতে ৭২০ টাকা দেন, আর সাথে আসেন, আপনাকে লাইনেও দাড়াতে হবে না। এই বলে মাত্র ১৫ মিনিটের মধে্য টাকাও জমা হয়ে গেল, নিবন্ধনও হয়ে গেল প্রবাস যাত্রী জয়নুল আবেদীনের।
শুধু জয়নুল আবেদীন নয়, এভাবে শত শত প্রবাসীকে এভাবে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী লাল মিয়া বলেন, সকাল আমি ৭টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। ৯টায় রেজিস্ট্রেশন শুরু হবে। লকডাউন আর বৃষ্টির মধ্যে অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি। রাতে আমার এক প্রতিবেশী বিকাশের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়েছে। তবে আমি কাল টাকা জমা দিইনি। ভেবেছিলাম এখানে এসে জমা দেব। কিন্তু এখানে এসে সারাদিন অনেকবার চেষ্টা করেছি। একবারও টাকা জমা দিতে পারছি না। ফলে নিবন্ধনও হচ্ছে না।
গোয়াইনঘাট উপজেলা থেকে আসা শরীফুল আলম নামে একজন বলেন, আমার সঙ্গে যিনি এসেছিলেন তিনি টাকা জমা দিতে পেরেছেন। কিন্তু আমি পরিনি। যাদের ই-পাসপোর্ট আছে তাদের টাকা জমা হচ্ছে। কিন্তু যাদের ই-পাসপোর্ট নেই তাদের টাকা বিকাশে নিচ্ছে না। বিকাশের বদলে নগদ টাকা জমা নেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এতে আমাদের ভোগান্তি কমবে। নইলে আমাদের বিদেশ যাওয়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এসময় অনেক প্রবাসী বলে উঠেন, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী আমাদের সিলেটের। কিন্তু ওনার নিজ জেলার প্রবাসীরা টিকার নিবন্ধনে এসে নানাভাবে হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে। অনেকে দাবি করেন, বিকাশে টাকা পেমেন্ট করার পর একটি মাত্র বুথ থাকায় কাগজপত্র জমা দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে নিবন্ধনের বুথ বাড়ানোর জন্য প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তারা।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস সিলেটের সহকারী পরিচালক মীর কামরুল হোসেন বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সৌদি ও কুয়েত প্রবাসীদের জন্য ফাইজারের টিকার নিবন্ধন করা হচ্ছে। ‘আমরা শুধু এখান থেকে তালিকা করে ঢাকায় পাঠাচ্ছি। টিকা কবে দেয়া হবে সেটি আমরাও জানি না। নিবন্ধনের সময় টিকা প্রদানের কোনো তারিখ বা স্থান বলা হচ্ছে না। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয় তারিখ নির্ধারণ করে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধনকারীর মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমে টিকার তারিখ ও স্থান জানিয়ে মেসেজ দেবে।’
তিনি জানান, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাংকের মাধ্যমে ২২৩ টাকা এবং মোবাইল মানি ট্রান্সফার (নগদ, বিকাশ, রকেট ইত্যাদি) মাধ্যমে দিলে ২০০ টাকা ফি প্রদান করতে হচ্ছে বিদেশগামী কর্মীদের। বিকাশ পেমেন্ট কিংবা যেকোন মাধ্যমে দেয়া হউক না কেন প্রত্যেককে সরসারি উপস্থিত থেকে কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এতে অন্য কেউর কাগজ জমা দেয়া বা নেয়ার কোন সুযোগ নেই। সচেতন অনেক প্রবাসীরা নিজে নিজেই টাকা পেমেন্ট দিচ্ছেন। এতে ভোগান্তি ও খরচ উভয় কমছে বলেও জানান তিনি। সার্ভার ডাউন বা বিকাশ পেমেন্টে সমস্যার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রকম সমস্যা বিভিন্ন সময়েই হয়। একসঙ্গে অনেকে যখন টাকা পরিশোধ করতে চান তখন এমন সমস্যা হতে পারে। তবে কিছুক্ষণ পর তা ঠিক হয়ে যায়। কেবল সিলেট না, দেশের অনেক জায়গায়ই এমন সমস্যা হচ্ছে বলে শুনেছি। বিকাশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এটি আপনাতেই ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, তার পরও প্রবাসীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা সমস্যাটি দ্রæত সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছি। আশা করছি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।