• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

রাজনীতি

বিতর্কিতরাও কৃষক লীগের পদপ্রত্যাশী

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর ২০১৯

আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগে পদপ্রত্যাশী রয়েছেন বিতর্কিত ও অভিযুক্ত বেশ কয়েকজন নেতা। সংগঠনের আগামী কেন্দ্রীয় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে তারা নানাভাবে কাঙ্ক্ষিত পদে প্রার্থিতার কথা জানান দিচ্ছেন। ক্যাসিনো ঝড় সংগঠনটির ওপর দিয়ে সেভাবে বয়ে না গেলেও এর শীর্ষ নেতারা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হন। তাদের কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকারকেও প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতে শুদ্ধি অভিযান চলাকালে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও পদবাণিজ্যে অভিযুক্তরা আবারো পদপ্রত্যাশী হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। তবে আগামী দিনে সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কয়েক নেতাও সম্ভাব্য পদপ্রার্থী।

কৃষক লীগের নীতিনির্ধারক সূত্র বাংলাদেশের খবরকে জানায়, আগামী ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পদপ্রত্যাশীদের নানা তৎপরতা চলছে। সংগঠনের শীর্ষ দুই পদ (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) পেতে আগ্রহীরা জোর তদবির চালাচ্ছেন। মূল দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের কাছে ধরনাও দিচ্ছেন অনেকে। গত কয়েকদিন ধরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও অনেকে নিয়মিত যাওয়া-আসা করছেন।

পাশাপাশি সম্মেলনকে ঘিরে বর্তমান শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে আসতে শুরু করেছে। চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যেই কৃষক লীগের সম্মেলনের জন্য রেলওয়ের কাছে চট্টগ্রামের নেতাদের ৩৮০টি ফ্রি টিকিটের আবদার নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকার কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের চেয়ারম্যান শফিকুল আলম ফিরোজকে ক্লাব থেকে অস্ত্র-গুলি, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব।

বলা হয়, আওয়ামী লীগের মূল কমিটিতে যারা ঠাঁই পান না, ঢাকা মহানগরে তাদের সন্তুষ্ট রাখতে সহযোগী সংগঠনগুলোতে পদ দেওয়া হয়। আর এসব পদ ব্যবহার করে অনেকে নানা রকম স্বার্থ হাসিল, ধান্ধা ও তদবির করছেন; শূন্য থেকে অনেকে কোটিপতি হয়েছেন। পদবাণিজ্যে কৃষক লীগের কয়েক নেতাও দলের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের সমান এগিয়ে আছেন।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এতদিন চুপ থাকলেও এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরব। দক্ষ, ত্যাগী ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে নিয়ে আসার দাবি উঠে আসছে তৃণমূল থেকে। নতুন করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে ইচ্ছুক নেতাদের মধ্যে অনেকে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে পুঁজি করে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছেন। সংগঠনের নেতৃত্বে নতুন মুখ উঠে আসার সম্ভাবনাই বেশি। সম্মেলনে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছা প্রাধান্য পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গড়া ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এ দলের নেতৃত্বের সরকার আগামী ২০২০ সালে তার জন্মশতবর্ষ ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। এর আগেই দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ সভাপতির কঠোর নির্দেশে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলছে। এর মাঝে সাত বছরেরও বেশি সময় পর কৃষক লীগের জাতীয় সম্মেলন হচ্ছে।

সূত্র বলছে, কৃষক লীগের বর্তমান সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা আবারো একই পদে থাকতে ইচ্ছুক। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শামসুল হক রেজা এবার সভাপতি পদ পেতে আগ্রহী। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত কমিটি ভেঙে দিয়ে ইচ্ছেমতো পদ বণ্টন ও বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ২০১২ সালে কমিটির অনুমোদন করে দিলেও পরে নিজেদের ইচ্ছায় অনেকের নাম ঢুকিয়ে তারা বাণিজ্য করেন। কমিটি থেকে কারো নাম বাদ দিতে এবং সভাপতি ও ও সাধারণ সম্পাদকের ‘নিজস্ব লোকের’ নাম যোগ করার ক্ষেত্রে কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ আছে।

যোগাযোগ করলে মোতাহার হোসেন গণমাধ্যমের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনো অভিযোগই সত্য নয়। কমিটি বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি কখনোই জড়িত ছিলেন না। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে একজন ব্যবসায়ীকে বর্তমান কমিটিতে সহসভাপতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’

সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত সংগঠনের সম্মেলনের আয়োজন যেমন করেননি, তেমনই অনেক জেলায় কমিটি নির্বাচন করার পরও টাকার বিনিময়ে একাধিক কমিটি পরিবর্তনের অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। প্রয়োজন না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও কানাডায় তারা কৃষক লীগের কমিটি গঠন করেন। অভিযোগ ওঠে, টাকার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় নেতারা বিদেশে কমিটি গঠন করেন। গত বছরের ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও কৃষক লীগের বৈদেশিক শাখা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তথ্যমতে, কৃষকের স্বার্থে কাজ করার প্রত্যাশায় ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন বাঙালির অবিসাংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। অথচ কৃষকদের স্বার্থে কোনো কর্মসূচি নেই সংগঠনটির। ১১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নামমাত্র সংখ্যক কৃষক আছেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। মোতাহার হোসেন মোল্লা গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও একজন ঠিকাদার ব্যবসায়ী। শামসুল হক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। নিজেদের কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার মতো জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিতেও তারা ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য দেন বলে অভিযোগ আছে। শুধু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ও মূল দলের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিও নেই সংগঠনটির।

এবার সভাপতি পদপ্রত্যাশী সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত দুই সহসভাপতি এম এ করিম ও কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা। সম্মেলনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার পর থেকে দুজনেই তৎপর আছেন। এম এ করিম কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে গন্ডগোলে জড়িয়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেরপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করায় বদিউজ্জামান বাদশাকে কৃষক লীগের সহসভাপতির পদ থেকে সরাসরি বহিষ্কার করা হয়। ওই বছরের ৯ জানুয়ারি বাদশাকে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বদিউজ্জামান তখন কেন্দ্রীয় কমিটির ওই সিদ্ধান্তের ‘তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি’ জানালেও এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সংগঠন।

অন্যদিকে এবার সভাপতি হিসেবে আলোচনায় রয়েছে প্রতিষ্ঠাকালীন ১১ সদস্যের মধ্যে একমাত্র জীবিত খান আলতাফ হোসেন ভুলুর নাম। তিনি বর্তমান কমিটির এক নম্বর সহসভাপতি। সভাপতি পদপ্রত্যাশীর তালিকায় আরো আছেন সংগঠনের বর্তমান সহসভাপতি সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক, সাবেক সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস, শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, শরীফ আশরাফ হোসেন, আকবর আলী চৌধুরী এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার। সাধারণ সম্পাদক পদের আলোচনায় আছেন সংগঠনের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সমীর চন্দ, সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু, সাখাওয়াত হোসেন সুইট, আবুল হোসেন, গাজী জসীম উদ্দিন, আসাদুজ্জামান বিপ্লব ও আতিকুল হক আতিক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads