• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
চমক জাগানো সিলেটের ভোটের ‘ময়নাতদন্ত’

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন

প্রতীকী ছবি

নির্বাচন

চমক জাগানো সিলেটের ভোটের ‘ময়নাতদন্ত’

কামরানের রাজনৈতিক জীবন কি শেষ?

  • প্রকাশিত ০১ আগস্ট ২০১৮

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও আবু তাহের চৌধুরী, সিলেট থেকে

‘মাত্রাতিরিক্ত ভোট চুরি’র পরও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ‘পিছিয়ে পড়া’ নিয়ে সিলেটে ব্যাপক কথাবার্তা চলছে। ভোটের সময় দিনভর শুধু অনিয়মের অভিযোগ জানাতেই ব্যস্ত থাকা বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হকের ‘ফলাফলে এগিয়ে থাকা’ নিয়ে বহুজন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, এমনটি হওয়া কীভাবে সম্ভব? একই সঙ্গে জামায়াতকে ভোটের ময়দানে নামিয়ে বিএনপিকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামা আওয়ামী লীগের এই কৌশল কেন ব্যর্থ হলো, তা নিয়েও হজরত শাহজালালের (রহ.) পুণ্যভূমিতে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, সিলেটে আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ হিসেবে কাজ করা জামায়াতের ভোট কোথায় গেল? ভোটের দিন যেখানে কেন্দ্রে কেন্দ্রে শুধু ‘নৌকা’ প্রতীকের লোক ছাড়া অন্যদের দেখা যায়নি, সেখানে দিনশেষে কামরান পরাজয়ের ‘মুখোমুখি’- এমন চিত্র শুধু সিলেটের মাটিতেই সম্ভব বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। এসব প্রশ্নকে ধারণ করে গত সোমবার সিলেট মহানগরীর ভোট শেষ হয়েছে। ‘চমকে ওঠার’ মতো ভোটের পরিসংখ্যান জানা গেলেও নির্বাচন কমিশন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশ করেনি।

ভোটের ফলাফলে আরিফ এগিয়ে থাকলেও ‘সিলেটের মেয়র কে’- এমন প্রশ্নের জবাব পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। আর এই কিছুদিনের মধ্যে শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘সুরমার জলও খানিকটা ঘোলা’ হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফলাফলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৪ জন, বিএনপির ৯ জন, জামায়াতের একজন এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। গোলযোগের কারণে দুটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়ায় ২৪ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ফলাফল স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া ১৯, ২০ ও ২১ ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ‘সংরক্ষিত-৭ আসনে’ দুজন প্রার্থী সমান ভোট হওয়ায় ফল প্রকাশ স্থগিত আছে। 

সিলেট সিটি করপোরেশনে ১৩৪টি কেন্দ্রে মোট ভোটার তিন লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন এবং নারী এক লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। রিটার্নিং অফিসার মো. আলীমুজ্জামান ১৩২টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করে জানান, এক লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৬ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। সাত হাজার ৩৬৭টি ভোট বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ এবার ভোটের হার ৬২ শতাংশের কাছাকাছি, গতবারও ভোটের হার ৬২ শতাংশই ছিল।

কিছু কিছু কেন্দ্রে মেয়র নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীকের ফলাফল নিয়ে ‘মাত্রাতিরিক্ত রহস্যের’ জন্ম দিলেও ১৩৪টির মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্র থেকে পাওয়া বেসরকারি ফলে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৬ হাজার ভোট। অন্যদিকে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। ফলে কামরানের চেয়ে চার হাজার ৬২৬ ভোট বেশি পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। যে দুটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রেখেছে নির্বাচন কমিশন সেখানে মোট ভোটার সংখ্যা চার হাজার ৭৮৭। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধানের চেয়ে ১৬১টি ভোট বেশি রয়েছে স্থগিত কেন্দ্র দুটিতে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধি অনুযায়ী এ রকম পরিস্থিতিতে মেয়র পদে জয়-পরাজয় ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই। স্থগিত দুটি ভোটকেন্দ্রের পুনর্নির্বাচনের পরই চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে রিটার্নিং অফিসার মো. আলীমুজ্জামান বলেন, সিলেটের স্থগিত হওয়া দুটি কেন্দ্রের ভোট দ্রুত নেওয়ার জন্য ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অফিসে গতকাল মঙ্গলবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত এর সমাধান হবে। এ ছাড়া একটি সংরক্ষিত আসনে দুজন প্রার্থীর ভোট সমান হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণেও কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

কামরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি শেষ? : সরকারিভাবে ফল ঘোষণা না হলেও ভোটের যে চিত্র দেখা গেছে, তাতে জটিল এক সমীকরণেই কেবল আরিফুল হক চৌধুরীকে হারিয়ে সিলেটের মেয়র হতে পারেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। জয়ী হতে হলে ওই দুটি কেন্দ্রের সব ভোট কামরানকে পেতে হবে। এটি কখনোই সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

তবে নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে কামরানের সমর্থকরা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেই দায়ী করছেন। এবারের নির্বাচনে কামরানকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়াও সঠিক হয়নি বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। কামরানের সঙ্গে জামায়াতের সুসম্পর্কের বিষয়টি সাধারণ ভোটাররা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই বুকে চাপা ক্ষোভ নিয়েও কামরানের নির্বাচনী প্রচারণার সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু কামরানের জন্য সত্যিকার অর্থে কাজ করেনি। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী বিগত সময়ে আরিফের কাছ থেকে কাজ পেয়েছে, কামরানের সময়ে পাননি। তাদের ভেতরেও আরিফের জন্য সমর্থন ছিল। এ ছাড়া যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই অন্তর দিয়ে কামরানের পক্ষে ছিলেন না।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ‘ঘরের শত্রু বিভীষণে’র ভূমিকায় থাকার কারণে নৌকার প্রার্থী বদরউদ্দিন কামরানের ভোটের ফলাফল এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে বলে মনে করেন। কেউ কেউ কামরানের ব্যক্তি ইমেজ সঙ্কটের কথাও বলছেন। আর এর মাধ্যমে কামরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

কামরান যখন পরপর দুবার সিলেটের মেয়র ছিলেন তখন এই আরিফ ছিলেন কাউন্সিলর। আজ কাউন্সিলর আরিফের কাছে পরাজয়ের পথে রয়েছেন কামরান। জানতে চাইলে সিলেট মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মুসফিক জায়গীরদার বলেন, এবারের সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘ষড়যন্ত্রের কাছে গণতন্ত্রের পরাজয়’ হয়েছে। এবার নৌকার পক্ষে যে জোয়ার ছিল, তাতে নৌকার বিপুল ভোটের ব্যবধানে পাস করার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মুখোশ পরে নির্বাচনী মাঠে অবস্থান করেছে। তারা নৌকার প্রার্থী বদরউদ্দিন কামরানের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে ছিল। কিন্তু তারা ভেতরে ভেতরে কামরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করেছে, ভোট দিয়েছে।

কামরান দাবি করেছিলেন সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে তিনি বহু কাজ করেছেন, সেই সংখ্যালঘুরাই কিন্তু কামরানকে ভোট দেননি। কেন সংখ্যালঘুরা কামরানকে ভোট দেননি- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে নানা রকম উত্তর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মনিপুরি সম্প্রদায়ের ভোটারও কামরানকে ভোট দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনিপুরি সম্প্রদায়ের দুজন ব্যক্তি জানান, কামরান মেয়র থাকাকালে সিলেটের লামাবাজে তাদের একটি ভূমি দখল হয়েছিল। সে সময় মনিপুরিদের পাশে কামরান থাকেননি। পরে আরিফ মেয়র হয়ে সেই ভূমি উদ্ধার করে দেন এবং মন্দিরও তৈরি করেন।

আরিফের এগিয়ে থাকার কারণ : বিএনপির প্রাথী আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচার ও প্রস্তুতির চিত্র ছিল ভিন্ন। শুধু জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য সবাই আরিফের পক্ষে কাজ করেছে। আরিফের ব্যক্তিগত ইমেজ এবং দলীয় ঐক্যের কাছেই কামরানের পরাজয় হয়েছে বলে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মনে করেন। এ ছাড়া বিএনপির প্রার্থী আরিফের জামায়াতবিরোধী মনোভাব সিলেটের প্রগতিশীলসহ সব শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তারা প্রকাশ্যে না এলেও গতবারের মতো এবারো আরিফকে ভোট দিয়েছেন। সিলেটে একাধিকবার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরও কামরান সিলেটবাসীকে উন্নয়ন দিতে পারেননি। দীর্ঘ সময়েও নগরীর সমস্যা দূর করতে পারেননি। অথচ আরিফ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই নগরবাসী জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে। নগরবাসীর চোখে এটা ছিল দৃশ্যমান। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং নগরীর রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য আরিফ কারো সঙ্গে আপোস করেননি। রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য জোটের শরিক দল জামায়াতের মালিকানাধীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজের সীমানাপ্রাচীর পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্যও আরিফুল হক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। তাদের পাশে থেকেছেন, ভালোবেসেছেন। এসবই ভোটের মাঠে আরিফকে এগিয়ে রাখে এবং তাকে ভোট দেয়।

জামায়াতের ভোট গেল কোথায় : আওয়ামী লীগ ভেবেছিল ভোটের মাঠে জামায়াত থাকলে বিএনপির অসুবিধা হবে। আওয়ামী লীগ পুরো সুবিধা নিয়ে মাঠে আসবে। কিন্তু বাস্তবে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। জামায়াত আলাদা ভোট করার পরও বিএনপির প্রার্থী এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পেছনে ফেলে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। জামায়াত আলাদা ভোট করে মাত্র ১০ হাজার ৯৯৫টি ভোট পেয়ে জামানত পর্যন্ত হারিয়েছে। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে সিলেট নগরীতে জামায়াতের ভোট গেল কোথায়? সিলেট জামায়াতের আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের টেবিল ঘড়ি প্রতীকে প্রাপ্ত ভোটের এ সংখ্যা নিয়ে নতুন প্রশ্ন- এটাই কি সিলেটৈ জামায়াতের প্রকৃত ভোট সংখ্যা? ভোটের প্রচার সময় জামায়াতের কর্মীরা দাবি করেছিলেন সিলেটে তাদের ভোটব্যাংক রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি। এ থেকে কম করে হলেও হাজার ত্রিশেক ভোট পাবেন। কিন্তু বাস্তবে জামায়াতের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ায় নতুন প্রশ্ন শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads