• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ছবি : সংগৃহীত

ইতিহাস-ঐতিহ্য

তাঁত : অশ্রু ও ঘামের ফোঁটা লেগে থাকে যে কাপড়ে

  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৮

একসময় বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রামগঞ্জ ছিল না, যেখানে দু-একটি তাঁতিপাড়া চোখে পড়ত না। সকাল থেকেই শুরু হতো খটখট শব্দ, চলত তা গভীর রাত পর্যন্ত। কোনো একটি পরিবার, পুরো একটি সম্প্রদায়, বংশের পর বংশ ধরে নির্ভর ছিল হাতে তৈরি এ যন্ত্রটির ওপর। পরনের সমস্ত কাপড়, গামছা-লুঙ্গি-শাড়ি থেকে শুরু করে রুমাল বালিশের কভার পর্যন্ত বোনা হতো তাঁতের কাপড়ে। আদিকাল থেকে মানুষের লজ্জা নিবারণের এ যন্ত্র এখন বিলুপ্তপ্রায়। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে বড় বড় কল-কারখানা-গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। তবে আশার কথা, এখনো দেশের ৪০ শতাংশ কাপড়ের চাহিদা মেটাচ্ছে হাতে তৈরি এই তাঁতশিল্প। তাঁত আদমশুমারি অনুযায়ী, বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এবং ডেমরা, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লার তাঁতের লুঙ্গি এখন পর্যন্ত বিখ্যাত। এখনো ৫ লাখ হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র রয়েছে। প্রায় ৫০ লাখ লোক এখনো সরাসরি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, কাপাসিয়া, কিশোরগঞ্জ, সোনারগাঁ, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেক স্থানে তাঁতশিল্প এখনো আগের মতোই সরব।

তাঁতের যন্ত্রটি এমন একটি যন্ত্র যার প্রতিটি যন্ত্রাংশই হাতে চালিত এবং হাতেই ব্যবহূত। তবে আধুনিক সময়ে এসে অনেক কল-কারখানায় স্বয়ংক্রিয় তাঁতযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে মেশিনের সাহায্যেই তাঁত চলে। তাঁত বোনা শব্দটি এসেছে ‘তন্তু বয়ন’ শব্দ থেকে। তাঁতিদের অনেক জেলায় ঝোলা বা জুলি বলা হয়। কারণ তাদের ঝোলানো হাতল টেনে তারা কাপড় বুনেন। ধারণা করা হয় আদি বসাক সম্প্রদায়ের লোকজন সিন্ধু সভ্যতা থেকে এ অঞ্চলে এসেছিল সেই প্রাচীন আমলেই। নদীবিধৌত এ অঞ্চল কাপড় বুননের জন্য যেমন অনুকূলে ছিল, তেমনি নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও ছিল যাতায়াতের সুবিধা। তাঁতিরা যে শুধু দেশীয় প্রয়োজন মেটাতেন তা নয়, তাদের উৎপাদিত কাপড় বাণিজ্য করতে যেত ভারতবর্ষসহ বহির্বাণিজ্যেও।

সেই প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্প কাপড় তৈরিতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। মসলিন, জামদানি তৈরি শুরু থেকে তাঁতশিল্পের ভূমিকা ছিল নানা রকম শৌখিন, কারুকার্যময় পোশাক তৈরিতে। তবে প্রয়োজনের তাগিদে তাদের প্রধান কাজ ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় সাধারণের পোশাক বানানোই। দেশীয় তুলা থেকে সুতা উৎপাদন করে তাঁতিরা নিজেরাই কাপড় তৈরি করে নেন। বেশিরভাগ তাঁতি সুতা বাজার থেকে কিনে নেন। প্রয়োজনীয় কাপড়ের মাপ, নকশা নিজেই তৈরি করেন। তাঁতিদের কারিগর বলা হলেও তারা প্রত্যেকেই একেকজন শিল্পী। যদিও আদিকাল থেকেই তাদের অবস্থা দিন আনি দিন খাইয়ের মতোই। এক গজ কাপড় তৈরিতে তাদের সারা দিন লাগলেও বর্তমানে তারা দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি মজুরি পান না। বংশপরম্পরায় এ পেশা চলে আসার কারণে দেশভাগের পর যখন আধুনিক শিল্প-কারখানা তৈরি হতে থাকে, তখন অনেক পরিবারের উত্তর-প্রজন্ম কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তাদের করুণগাথা লেখা আছে বাংলা ভাষার অসংখ্য সাহিত্যে। প্রাচীনকাল থেকে অপরূপ কাপড়ে মানুষের সারাদেহ ঢেকে দিয়েছিলেন যারা, সেই কাপড়ের প্রতিটি সুতোয় সুতোয় লেগে আছে তাঁতিদের অশ্রু ও ঘামের গন্ধ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads