• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ইতিহাস-ঐতিহ্য

যে প্রতীকগুলোয় বাংলাদেশের পরিচয়

  • ফিচার ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২০ এপ্রিল ২০১৮

কোনো জাতিকে চেনার জন্য, সেই জাতির জাতীয় প্রতীকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে ওই প্রতীকগুলো। প্রায় প্রত্যেকটি দেশেরই এমন কিছু প্রতীক রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশেরও এমন কিছু প্রতীক আছে। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সময়ই তৎকালীন নেতৃত্ব বেশকিছু জাতীয় প্রতীকের নাম ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে আরো কিছু প্রতীক নির্বাচন করা হয়েছে। ফুল, ফল, পতাকা, সঙ্গীত, কবি, পাখি, বৃক্ষ, মাছ, পশু, উদ্যান, খেলা, সৌধ, মসজিদ, মন্দির, নদী ইত্যাদি বেশকিছু ক্ষেত্রের প্রতীককে জাতীয়করণ করা হয়েছে। জেনে নিতে পারেন এই প্রতীকগুলোকে-

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক

‘জাতীয় প্রতীক’ একটি দেশের পরিচয়কে বহন করে। যেহেতু জাতীয় প্রতীক একটি দেশ সম্পর্কে ধারণা দেয়, তাই জাতীয় প্রতীকে ব্যবহূত বিষয়বস্তুগুলো নির্ধারণ করা হয় সে দেশের নিজস্ব সম্পদ এবং স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান প্রকাশ করে এমন সহজলভ্য সম্পদের মাধ্যমে। এ ছাড়া অন্য কোনো দেশের প্রতীকে ব্যবহূত হয়েছে এমন জিনিস বাদ দিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানা যায়। শিল্পী কামরুল হাসানের ডিজাইনকৃত প্রতীকটি ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় প্রতীকের মর্যাদা পায়। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রাকৃতিক নিসর্গ এবং জাতি হিসেবে আমাদের দৃঢ়তা। জাতীয় প্রতীকে রয়েছে দু’পাশে দুটি ধানের শীষের মাঝখানে একটি ভাসমান শাপলা। শাপলার ঠিক ওপরে তিনটি সংযুক্ত পাটপাতা এবং পাতার উভয় প্রান্তে দু’টি করে চারটি তারকা। প্রতীকে ব্যবহূত প্রতিটি বস্তু ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। পানি, ধান ও পাট প্রতীকের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিসর্গ ও অর্থনীতি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। প্রতীকে ব্যবহূত ভাসমান শাপলা হলো অঙ্গীকার, সৌন্দর্য ও সুরুচির প্রতীক এবং প্রতীকে ব্যবহূত চারটি তারকা জাতির লক্ষ্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এই প্রতীক ব্যবহারের এখতিয়ার রাখেন শুধু রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী।

 

জাতীয় মসজিদ

বায়তুল মোকাররম মসজিদ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর এ মসজিদটি ঢাকায় অবস্থিত। ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরানঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। বিশিষ্ট স্থপতি টি. আবদুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পুরো কমপ্লে­ক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি­ নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের প্রধান কক্ষটি তিনদিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। মিহরাবটি অর্ধ-বৃত্তাকারের পরিবর্তে আয়তাকার। আধুনিক স্থাপত্যে কম অলঙ্করণই একটি বৈশিষ্ট্য যা এই মসজিদে লক্ষণীয়। এর অবয়ব অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো হওয়ায় মুসলমানদের হূদয়ে এই মসজিদটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

 

জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরটি রাজা বল্লাল সেন ১২০০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় নির্মাণ করেছিলেন। এর পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি এই মন্দিরটি কালক্রমে ঢাকার জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার পূর্ব পাশে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের দক্ষিণ-পশ্চিমে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের অবস্থান। মূল মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে মহানগর পূজামণ্ডপ অবস্থিত। এখানে দুর্গাপূজার স্থায়ী বেদি রয়েছে। মূল মন্দির এলাকার ভবনগুলো উজ্জ্বল হলুদাভ ও লাল বর্ণের। মূল মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে চারটি শিব মন্দির। মূল মন্দিরটি পূর্বাংশে অবস্থিত। এখানে দেবী দুর্গার একটি ধাতু-নির্মিত প্রতিমা রয়েছে। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি তত্ত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

 

মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানা

বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানাটি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত এবং ১৯৬৪ সালে স্থাপিত। ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্বরে জীবজন্তুর প্রদর্শনশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় চিড়িয়াখানাটি। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে মিরপুরে স্থানান্তরিত হয় এটি। চিড়িয়াখানাটি উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নাম পরিবর্তন করে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা নামকরণ করা হয়। প্রায় ৭৫ হেক্টর জমির ওপর তৈরি চিড়িয়াখানার চত্বরে ১৩ হেক্টরের দুটি লেক আছে। বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ১৯১ প্রজাতির ২ হাজার ১৫০টি প্রাণী রয়েছে। বছরে প্রায় ৩০ লাখ দর্শনার্থী ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে থাকেন।

 

সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য ত্যাগ ও শৌর্যের স্মৃতি হিসেবে সাভার স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে সৌধ নির্মাণের নকশার জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ৫৭ জন প্রতিযোগীর মধ্য থেকে স্থপতি মঈনুল হোসেনের নকশাটি নির্বাচিত হয়। অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজাকৃতির প্রাচীর নিয়ে মূল সৌধটি গঠিত। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের ভিত্তির ওপর, আর সর্ব দীর্ঘ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। প্রাচীরগুলি মাঝখানে একটি ভাঁজ দ্বারা কোনাকৃতির এবং একটির পর একটি সারিবদ্ধভাবে বসানো। কাঠামোটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামোয় দেখা যায়। স্মৃতিসৌধের সাতজোড়া স্তম্ভ স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় নির্দেশ করে। এগুলো হল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষটি ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।

জাতীয় নদী- যমুনা

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে যমুনা একটি। এ নদী আমাদের জাতীয় নদী হিসেবে স্বীকৃত। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রধান শাখা। এর পূর্ব নাম জোনাই। ১৭৮৭ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নতুন খাতে প্রবাহিত হয়ে এই নদীর সৃষ্টি করেছে। উৎপত্তিস্থল হতে যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার। যমুনা নদীর সর্বাধিক প্রস্থ ১২০০ মিটার। যমুনার প্রধান উপনদীগুলো হলো তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, সুবর্ণশ্রী। প্রকৃতিগতভাবে যমুনা নদীটি বিনুনি অথবা চরোৎপাদী প্রকৃতির। এর বিনুনি বলয়ের মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য চর রয়েছে। যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিমি দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

 

জাতীয় পোশাক- শাড়ি ও কুর্তা

পোশাক একটি দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব জাতীয় পোশাক রয়েছে। জাতীয় পোশাক সহজেই একটি দেশকে একটি জাতিকে অন্য একটি জাতি থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক হলো শাড়ি ও কুর্তা। বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপ ফুটিয়ে তুলতে শাড়ির কোনো বিকল্প হয় না। বাঙালি নারীরা তাই শাড়ি পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সবচেয়ে বেশি। যেকোনো আচার অনুষ্ঠানে শাড়িই তাদের একমাত্র পছন্দ। ছেলেরাও কুর্তা পরে অনেক আগে থেকেই। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় শাড়ি এবং কুর্তা মানিয়ে যায় খুব সহজেই।

জাতীয় মাছ- ইলিশ

ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ। শুধু ডিম পাড়তেই এই মাছটি বাংলাদেশের বড় বড় নদীগুলোকে বেছে নেয়। ডিম পেড়ে সাগরে ফিরে যাওয়ার পথে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ইলিশ। সরাসরি সাগর থেকেও ইলিশ ধরা হয়, তবে সাগরের ইলিশ অতটা সুস্বাদু নয়। বাংলাদেশের ইলিশের সুনাম আছে সারা বিশ্বেই। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকহারে শিকার এবং নদীগুলো নাব্যতা হারানোর কারণে ইলিশের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এজন্য জাতীয় উদ্যোগে প্রজনন মৌসুমে অন্তত দুই মাস এই মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাটকা ধরাও আইনত দণ্ডনীয়। ২০১৭ সালে ইলিশকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) মাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

 

 

জাতীয় বৃক্ষ- আমগাছ

আমাদের জাতীয় ফুল, ফল, থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের কোনো জাতীয় বৃক্ষ ছিল না। ২০১০ সালের মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা দেওয়া হয়। আম খেতে ভালোবাসেন না, এমন বাঙালি পাওয়া কঠিন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় আমের পক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছে সেগুলো হলো- আমগাছ দেশের বেশির ভাগ মানুষ চেনে। আমগাছ নেই এমন বাড়ি গ্রামাঞ্চলে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। কারো বাড়িতে ১০টি গাছ থাকলে অন্তত একটি আমগাছ থাকবেই। ফল সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এর কাঠ ঘর ও আসবাব তৈরিতে বেশ ব্যবহূত হয়।

এ ছাড়া ১৯৫৭ সালের পলাশীর আমবাগানের যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের মুজিবনগর আমবাগানে মুক্তিযুদ্ধের শপথ ইত্যাদি ঐতিহাসিক পটভূমি বিবেচনা করে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করা হয়। আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়াত বৃক্ষপ্রেমী দ্বিজেন শর্মার সংগঠন ‘তরুপল্লব’-এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

 

জাতীয় পশু- রয়েল বেঙ্গল টাইগার

গাঢ় হলুদ থেকে লালচে হলুদ, তাতে লম্বা কালো ডোরা, পেটের দিক সাদাটে। হলুদ রঙের লেজে অনেক কালো বেড়। কানের পেছন কালো রঙের, তাতে একটি স্পষ্ট সাদা দাগ। চোখের মণি গোল। শক্তি, লালিত্য, সতর্কতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ধৈর্যের প্রতীক যেন রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাংলাদেশের জাতীয় পশু। বর্তমানে এটি শুধু সুন্দরবনে পাওয়া গেলেও, এক সময় এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াত। পঞ্চাশের দশকেও মধুপুর এবং ঢাকার গাজীপুরে বেঙ্গল টাইগার দেখা যেত। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে আর মাত্র ১০৬টি বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের অহঙ্কারের প্রতীক এই বাঘ এদেশের ক্রিকেট দলের প্রতীকী নাম হিসেবেও ব্যবহূত হয়। বাঘ (Panthera tigris) বড় বিড়াল জাতের অন্তর্ভুক্ত একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। সিংহ, চিতাবাঘ ও জাগুয়ারের সঙ্গে প্যানথেরা গণের চারটি বিশালাকার সদস্যের মধ্যে বাঘ একটি। এটি ফেলিডি (বিড়াল) পরিবারের সবচেয়ে বড় প্রাণী।

 

জাতীয় খেলা- কাবাডি

একসময়ের গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলার নাম হা-ডু-ডু। একসময় আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল জনপ্রিয় এই খেলাটি। বিশেষ করে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আনাচে-কানাচে হা-ডু-ডুকে ঘিরে রীতিমতো মেলা বসে যেত। এক সময়ের জনপ্রিয় এই খেলা এখন শুধু পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ। এই খেলার আরেক নাম কাবাডি। খুব অল্প জায়গাতেই খেলা যায় অনাড়ম্বর এই খেলা। হা-ডু-ডু এই অঞ্চলে কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও অনুমান করা হয়, হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এ ধরনের খেলা চলে আসছে এই বাংলায় তথা ভারতীয় উপমহাদেশে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সালে হা-ডু-ডু খেলাকে কাবাডি নামকরণ করা হয়। একই সময়ে কাবাডি খেলাকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়।

 

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান- মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান

১৯৬১ সালে ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। ঢাকা চিড়িয়াখানার পাশেই অবস্থিত। এটি ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নামেও অধিক পরিচিত। ২০৮ একর জায়গার জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই জাতীয় উদ্যানটি। এতে প্রায় ৮০০ প্রজাতির বিভিন্ন গাছ রয়েছে। বর্তমানে ৮৪.২ হেক্টর (২০৮ একর) জায়গায় বিরল প্রজাতির গাছপালা নিয়ে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন) এখন একটি জীবন্ত সংগ্রহশালা। এ ছাড়া জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রায় ৬০ প্রজাতির বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের সংগ্রহ রয়েছে। এদের মধ্যে বাঁশপাতা, চন্দন, রাজা অশোক, ক্যামেলিয়া, আমাজান লিলি, আগর, রামবুটাম, তমাল, ভূর্জপত্র, উদল, স্টারকুলিয়া, ক্যাকটাস, অর্কিড অন্যতম। ফুল, ফলের বাগান ছাড়া এতে পুকুর, দিঘি ইত্যাদি রয়েছে।

ঢাকা শহরের ভেতরে অবস্থিত বলধা গার্ডেনও প্রশাসনিকভাবে এই উদ্যানেরই অংশ। এটি ঢাকাবাসী তো বটেই, সারা দেশের মানুষের কাছেও বেশ আকর্ষণীয় একটি ভ্রমণের জায়গা।

 

জাতীয় উদ্যান- ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান

গাজীপুরে অবস্থিত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানই বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যান। পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয় উদ্যানের আদলে ৫ হাজার ২২ হেক্টর জমিতে ১৯৭৩-৭৪ সালে এই উদ্যান সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৮২ সালে। এক সময় ভাওয়াল উদ্যানে বিচরণ করত ব্ল্যাক প্যান্থার, চিতা বাঘ, ময়ূর, এমনকি হাতিও। এসব এখন ইতিহাস। ক্রমাগত বন উজাড়ের ফলে দিনে দিনে এর পরিধি কমে আসায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নানা বন্যপ্রাণী।

এই উদ্যানে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে ১৯টি বিশ্রামাগার ও ৩১টি পিকনিক স্পট। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মূল উদ্ভিদ হলো শাল। প্রায় ২২০ প্রজাতির গাছপালা আছে বনে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৩ প্রজাতির বিভিন্ন রকম গাছ, ১৯ প্রজাতির গুল্ম, তিন প্রজাতির পাম, ২৭ প্রজাতির ঘাস, ২৪ প্রজাতির লতা, ১০৪ প্রজাতির ঔষধি গাছ। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই বনে প্রায় ১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির উভচর প্রাণীও রয়েছে।

 

জাতীয় জাদুঘর- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা জাদুঘর নামে যাত্রা শুরু করেছিল জাতীয় জাদুঘর। তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে এর উদ্বোধন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে একে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর নামকরণ করা হয়।

চারতলা এই ভবনের স্থাপত্য নকশা অত্যন্ত নজরকাড়া। ২০ হাজার বর্গমিটারের এই ভবনটির ৪৬টি গ্যালারিতে রয়েছে প্রায় ৮৩ হাজারের বেশি নিদর্শন। কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্ববৃহৎ জাদুঘর। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতার প্রতিটি ধাপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এই প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।

 

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক

‘জাতীয় প্রতীক’ একটি দেশের পরিচয়কে বহন করে। যেহেতু জাতীয় প্রতীক একটি দেশ সম্পর্কে ধারণা দেয়, তাই জাতীয় প্রতীকে ব্যবহূত বিষয়বস্তুগুলো নির্ধারণ করা হয় সে দেশের নিজস্ব সম্পদ এবং স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান প্রকাশ করে এমন সহজলভ্য সম্পদের মাধ্যমে। এ ছাড়া অন্য কোনো দেশের প্রতীকে ব্যবহূত হয়েছে এমন জিনিস বাদ দিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানা যায়। শিল্পী কামরুল হাসানের ডিজাইনকৃত প্রতীকটি ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় প্রতীকের মর্যাদা পায়। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রাকৃতিক নিসর্গ এবং জাতি হিসেবে আমাদের দৃঢ়তা। জাতীয় প্রতীকে রয়েছে দু’পাশে দুটি ধানের শীষের মাঝখানে একটি ভাসমান শাপলা। শাপলার ঠিক ওপরে তিনটি সংযুক্ত পাটপাতা এবং পাতার উভয় প্রান্তে দু’টি করে চারটি তারকা। প্রতীকে ব্যবহূত প্রতিটি বস্তু ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। পানি, ধান ও পাট প্রতীকের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিসর্গ ও অর্থনীতি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। প্রতীকে ব্যবহূত ভাসমান শাপলা হলো অঙ্গীকার, সৌন্দর্য ও সুরুচির প্রতীক এবং প্রতীকে ব্যবহূত চারটি তারকা জাতির লক্ষ্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এই প্রতীক ব্যবহারের এখতিয়ার রাখেন শুধু রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী।

 

জাতীয় মসজিদ

বায়তুল মোকাররম মসজিদ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর এ মসজিদটি ঢাকায় অবস্থিত। ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরানঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। বিশিষ্ট স্থপতি টি. আবদুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পুরো কমপ্লে­ক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি­ নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের প্রধান কক্ষটি তিনদিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। মিহরাবটি অর্ধ-বৃত্তাকারের পরিবর্তে আয়তাকার। আধুনিক স্থাপত্যে কম অলঙ্করণই একটি বৈশিষ্ট্য যা এই মসজিদে লক্ষণীয়। এর অবয়ব অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো হওয়ায় মুসলমানদের হূদয়ে এই মসজিদটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

 

জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরটি রাজা বল্লাল সেন ১২০০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় নির্মাণ করেছিলেন। এর পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি এই মন্দিরটি কালক্রমে ঢাকার জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার পূর্ব পাশে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের দক্ষিণ-পশ্চিমে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের অবস্থান। মূল মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে মহানগর পূজামণ্ডপ অবস্থিত। এখানে দুর্গাপূজার স্থায়ী বেদি রয়েছে। মূল মন্দির এলাকার ভবনগুলো উজ্জ্বল হলুদাভ ও লাল বর্ণের। মূল মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে চারটি শিব মন্দির। মূল মন্দিরটি পূর্বাংশে অবস্থিত। এখানে দেবী দুর্গার একটি ধাতু-নির্মিত প্রতিমা রয়েছে। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি তত্ত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

 

মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানা

বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানাটি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত এবং ১৯৬৪ সালে স্থাপিত। ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্বরে জীবজন্তুর প্রদর্শনশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় চিড়িয়াখানাটি। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে মিরপুরে স্থানান্তরিত হয় এটি। চিড়িয়াখানাটি উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নাম পরিবর্তন করে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা নামকরণ করা হয়। প্রায় ৭৫ হেক্টর জমির ওপর তৈরি চিড়িয়াখানার চত্বরে ১৩ হেক্টরের দুটি লেক আছে। বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ১৯১ প্রজাতির ২ হাজার ১৫০টি প্রাণী রয়েছে। বছরে প্রায় ৩০ লাখ দর্শনার্থী ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে থাকেন।

 

সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য ত্যাগ ও শৌর্যের স্মৃতি হিসেবে সাভার স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে সৌধ নির্মাণের নকশার জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ৫৭ জন প্রতিযোগীর মধ্য থেকে স্থপতি মঈনুল হোসেনের নকশাটি নির্বাচিত হয়। অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজাকৃতির প্রাচীর নিয়ে মূল সৌধটি গঠিত। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের ভিত্তির ওপর, আর সর্ব দীর্ঘ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। প্রাচীরগুলি মাঝখানে একটি ভাঁজ দ্বারা কোনাকৃতির এবং একটির পর একটি সারিবদ্ধভাবে বসানো। কাঠামোটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামোয় দেখা যায়। স্মৃতিসৌধের সাতজোড়া স্তম্ভ স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় নির্দেশ করে। এগুলো হল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষটি ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।

 

জাতীয় নদী- যমুনা

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে যমুনা একটি। এ নদী আমাদের জাতীয় নদী হিসেবে স্বীকৃত। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রধান শাখা। এর পূর্ব নাম জোনাই। ১৭৮৭ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নতুন খাতে প্রবাহিত হয়ে এই নদীর সৃষ্টি করেছে। উৎপত্তিস্থল হতে যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার। যমুনা নদীর সর্বাধিক প্রস্থ ১২০০ মিটার। যমুনার প্রধান উপনদীগুলো হলো তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, সুবর্ণশ্রী। প্রকৃতিগতভাবে যমুনা নদীটি বিনুনি অথবা চরোৎপাদী প্রকৃতির। এর বিনুনি বলয়ের মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য চর রয়েছে। যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিমি দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

 

জাতীয় পোশাক- শাড়ি ও কুর্তা

পোশাক একটি দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব জাতীয় পোশাক রয়েছে। জাতীয় পোশাক সহজেই একটি দেশকে একটি জাতিকে অন্য একটি জাতি থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক হলো শাড়ি ও কুর্তা। বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপ ফুটিয়ে তুলতে শাড়ির কোনো বিকল্প হয় না। বাঙালি নারীরা তাই শাড়ি পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সবচেয়ে বেশি। যেকোনো আচার অনুষ্ঠানে শাড়িই তাদের একমাত্র পছন্দ। ছেলেরাও কুর্তা পরে অনেক আগে থেকেই। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় শাড়ি এবং কুর্তা মানিয়ে যায় খুব সহজেই।

জাতীয় গ্রন্থাগার

বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম বই। বই পড়ার মাধ্যমে অতি সহজে জানা যায় বিভিন্ন জাতির জীবন দর্শন, ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতি সবকিছু। বই পড়া মানুষকে করে তোলে আত্মসচেতন। বই পড়ার জন্য ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।

এটি গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের পূর্বে, রমনা মার্কেটের দক্ষিণে, টিসিবি ভবনের পশ্চিমে অবস্থিত। জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনটি পঞ্চম তলা বিশিষ্ট। এর দ্বিতীয় তলায় একটি হলরুম ও অন্য পাশে বই ও অন্যান্য ম্যাগাজিন এবং গবেষণাপত্র বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। এর তৃতীয় তলায় গবেষণা কেন্দ্র এবং প্রশাসন কেন্দ্র রয়েছে। আর চতুর্থ তলায় রয়েছে লাইব্রেরি।

জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রায় সব ধরনের বই রয়েছে। প্রশাসনিক হিসাব অনুযায়ী ১৯ হাজারের বেশি বই রয়েছে সেখানে। এখানে বিভিন্ন ধরনের বই যেমন- ছোটদের থেকে শুরু করে বড়দের বিজ্ঞান, ইতিহাস, আইন, সংস্কৃতি, উপন্যাস, ধর্মীয় ইত্যাদি বই পাওয়া যায়।

 

বাংলাদেশের যা কিছু জাতীয় মর্যাদাপ্রাপ্ত!

 

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা

১৯৭১ সালের ৬ জুন মধ্যরাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (এখনকার জহুরুল হক হল) বসে আড্ডা দিচ্ছে একদল ছাত্রনেতা নেতা- আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম। তাদের সঙ্গে উপস্থিত আছেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ। পরদিন পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে আসবেন। সেখানে নতুন কী করা যায়? তারা ভাবলেন জাতীয় পতাকা নিয়ে যাওয়া যাক। পাকিস্তানের চাঁদ-তারার পতাকা তারা আর মানেন না। তারা নিয়ে যাবেন নতুন দেশের নতুন একটি পতাকা। কিন্তু সেই পতাকা পাবেন কোথায়? রাত দুপুরে তারা গিয়ে হাজির হলেন নিউ মার্কেটের  অ্যাপোলো টেইলার্সে। অ্যাপোলো টেইলার্সের মালিক বজলুর রহমান লস্করের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নিলেন তারা। সেই কাপড় নিয়ে  গেলেন নিউ মার্কেটের এক বিহারি দর্জির দোকানে। রাত বারোটায় দর্জিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাকে দিয়ে কাপড়টি সেলাই করালেন। শিবনারায়ণ দাস ছিলেন স্বভাবশিল্পী। তিনি কাপড়টির মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত এঁকে দিলেন স্রেফ ম্যাচের কাঠির রঙ দিয়ে। পরদিন বঙ্গবন্ধু পল্টনে আসেননি। পতাকাটি রয়ে গিয়েছিল আ স ম আবদুর রবের কাছে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তিনি পতাকাটি নিয়ে বেরিয়ে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজের বাসভবন ৩২ নাম্বারে পতাকাটি উড়িয়েছিলেন। তখন সেই পতাকার লালবৃত্তের মাঝখানে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র। স্বাধীনতার পর মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়। তখন এর চূড়ান্ত নকশা করতে দেওয়া হয় শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানকে। চারপাশের মাপ ঠিক করে তিনি পতাকাটির পরিমার্জিত চূড়ান্ত নকশা করেন।

 

জাতীয় সঙ্গীত

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গের সময় স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই গানটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলকাতার টাউন হলে গানটি প্রথম গেয়েছিলেন গোপাল চন্দ সেন। কুষ্টিয়ার বাউল গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে..’ গানটির সুরই রবীন্দ্রনাথ তার গানে ব্যবহার করেছিলেন। ডাকপিয়নের দায়িত্ব পালনের সময় গগন চিঠি নিয়ে গান গাইতে গাইতে প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যেতেন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে ৩ মার্চ ঘোষিত ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার ২৫ লাইনের এ গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে আমার সোনার বাংলাকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করেন। বিবিসির জরিপে এটি সেরা দশটি বাংলা গানের একটি। ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড ময়দানে সমবেত শিল্পীদের সঙ্গে সারা দেশের ২ কোটি ৫৪ লাখ ৫৩৭ জন একসঙ্গে এ গান গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করে।

 

জাতীয় পাখি দোয়েল

বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল। সাদা আর কালো রঙের ছোট্ট এই পাখিটির ভীষণ মিষ্টি গলা। পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চির মতো লম্বা হয় এরা। পুরো দেহ উজ্জ্বল কালো বর্ণের। তবে এদের গলার নিচ থেকে বুক পর্যন্ত এবং ডানা বরাবর সাদা রেখা দেহের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। লেজে সাদা ও নীলের মিশ্রণ সত্যিই নয়নাভিরাম। শরীরের তুলনায় লেজ লম্বা। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই পাখির দেখা মেলে। তবে শহরাঞ্চলে এ পাখিটির দেখা পাওয়া ভার। কারণ বাংলার গ্রামীণ সবুজ পরিবেশই তাদের পছন্দ। ঘন জঙ্গলের চেয়ে সাধারণত বাড়িঘরের আশপাশেই থাকতে ভালোবাসে পাখিটি। দোয়েল বিভিন্ন সুরে গান গাইতে পারে। শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় এরা গান গায় বেশি। শীত কিংবা বসন্তে দুই থেকে চারটি ডিম পাড়ে এ পাখি। একটি দোয়েল ১৪ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গই এদের প্রধান খাবার।

 

জাতীয় ফল কাঁঠাল

বাংলাদেশের ফলের নাম এলেই সবার আগে আসবে কাঁঠালের নাম। বাংলাদেশের সমভূমি থেকে পাহাড় সব জায়গায় পাওয়া যায় এই ফল।

কাঁচা অবস্থায় এটি রান্না করে খাওয়া যায়। পাকলে রসালো, মিষ্টি ও গন্ধে ভরপুর বৃহদাকারের এই ফলটি। কাঁঠালের আছে নানা পুষ্টিগুণ। এতে রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিন। বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, উচ্চ রক্তচাপ দূর করে ফলটি। কাঁঠাল গাছের শেকড় হাঁপানি দূর করে। সাধারণত লালচে মাটি ও উঁচু এলাকায় কাঁঠাল গাছ বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং পার্বত্য এলাকায় কাঁঠালের চাষ বেশি হয়।

জাতীয় ফুল শাপলা

সাধারণত আবদ্ধ জলাভূমিতে শাপলা ফুল ফোটে। এদেশের অসংখ্য বিল পুকুর ডোবা নালায় আপনা থেকেই শাপলা ফুলের দেখা মেলে। বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির শাপলা ফুলের দেখা মিললেও সাদা রঙের শাপলাকেই জাতীয় ফুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পানিতে ভাসমান এই ফুল একটি নরম ডাঁটার অগ্রভাগে ফোটে। ডাঁটার শেকড়টি পানির নিচে কাদামাটিতে থাকে। একাত্তরের অগ্নিঝরা ১২ মার্চে শাপলাকে জাতীয় ফুল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। শিল্পী কামরুল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভায় এ ঘোষণা দেওয়া হয়। শাপলা ফুলের কাণ্ড সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। এ ছাড়া শাপলার বীজও বিভিন্ন উপায়ে ভক্ষণযোগ্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads