• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
রোহিঙ্গা সঙ্কটে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে বাংলাদেশ

সংরক্ষিত ছবি

জাতীয়

রোহিঙ্গা সঙ্কটে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

অন্তরায় হতে পারে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ওঠার পথেও

  • আহমদ আতিক
  • প্রকাশিত ০৯ জুলাই ২০১৮

বিশ্ববাসীর সমর্থন ও প্রশংসা পেলেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ভোগান্তি কম পোহাতে হচ্ছে না বাংলাদেশকে। স্থানীয় ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াও অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিষয়টিই সবেচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে সরকারকে। মিয়ানমারে সৃষ্ট এই সঙ্কট ক্রমেই বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি করছে।

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), বিশ্বব্যাংক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহমর্মিতা জানিয়েছে এবং সহায়তা দিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছে কক্সবাজারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সহায়তা পাওয়ায় মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ওঠা এবং এসডিজি অর্জনের পথেও বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যু সমস্যা হয়েই দেখা দিচ্ছে।

এই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানিদের হস্তক্ষেপে সর্বপ্রথম প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আসে। এরপর ১৯৬৫ সালে জাতিগত দাঙ্গা এবং ১৯৭৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় মিয়ানমার সরকার। এরপর ১৯৯১, ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ঘটলেও জাতিসংঘের মধ্যস্থতা এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়। ২০১২ সালে উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ফের বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কঠোর দমন-পীড়নে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হলেও তা শুরু না করায় সঙ্কট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সমঝোতা চুক্তির পর মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, প্রতিদিন ৩০০ এবং প্রতি সপ্তাহে ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে মিয়ানমার। এভাবে দুই বছরের মধ্যে সব উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাবে। কিন্তু এখনো এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার প্রশাসন। এর মধ্যে বর্ষা শুরু হওয়ায় বিরাট সংখ্যক শরণার্থীর জন্য নতুন আবাসন ও দুর্যোগ থেকে রক্ষার বিষয়টি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রভাবশালী মন্ত্রীরা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে কক্সবাজার ঘুরে গেছেন। মিয়ানমারের ওপর প্রভাব রাখে এমন দেশ- চীন, জাপান এবং আসিয়ানের দেশগুলোর নেতারাও এসেছেন। সবাই একবাক্যে জানিয়েছেন, ইস্যুটির সমাধানে তারা বাংলাদেশের পাশে আছেন। কিন্তু এখনো মিয়ানমারের ওপর তেমন একটা চাপ বাড়াতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানান, বাংলাদেশ মানবিক কারণে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ চায় এসব রোহিঙ্গা নিজ দেশে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে প্রত্যাবাসিত এবং তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টিরও সুরাহা হোক।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্রয় দেওয়া এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে অর্থনীতির ঝুঁকি ও অপরাধ- দুটোই বাড়াবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে ফেলবে রোহিঙ্গারা। শুধু চাপই নয়, এরা বোঝা হয়ে থাকবে। রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদে থাকলে এবং পরে ফেরত পাঠাতে না পারলে সব দিক থেকেই বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়বে। আমাদের বার্ষিক বাজেট ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি বাড়বে।’

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অসংখ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় কক্সবাজারসহ ওই এলাকার পর্যটন, অর্থনীতি ও পরিবেশ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু রোহিঙ্গার খাদ্যের জোগান দিতে এবং সামাজিক ও মানবিক সহায়তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ।’ যার বিরূপ প্রভাব শুধু কক্সবাজার এলাকায় নয়, বরং দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে পড়বে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেইন বলেন, ‘লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর কারণে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার গতি ধীর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নেও বাধা হয়ে উঠতে পারে এই সমস্যা। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা না করলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি পূরণ দুরূহ হয়ে পড়বে।’

এ অবস্থায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চাপ কার্যকর করতে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চায় বাংলাদেশ। ঢাকার প্রত্যাশা- জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিরাপত্তা পরিষদে তুলে ধরবেন এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবেন। এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মোমেনের মতে, ‘রোহিঙ্গারা এখন আমাদের গলার কাঁটা।’ তিনি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, ‘ইউরোপে যেভাবে অভিবাসী ভাগাভাগির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হচ্ছে; তেমনি রোহিঙ্গাদেরও আসিয়ান দেশ এবং সৌদি আরব, তুরস্ক, চীনসহ বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দিতে পারলে আমাদের ওপর চাপ কিছুটা কমবে।’

রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়া এমনিতেই বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলে ট্রানজিশনাল টেররিজম বহু যুগ ধরে রয়েছে। খোলা বা অনিয়ন্ত্রিত বর্ডার, ধর্মীয় এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকায় এই অঞ্চলটিতে সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রসবর্ডার সুবিধার কারণে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এশিয়ার এই অঞ্চলটি। তাদের শঙ্কা, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে উগ্র মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে শুরু করবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠন।

নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লেকেন গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো উগ্রবাদ সৃষ্টি করতে পারে। এর আগে আসিয়ানের মানবাধিকার নেতারাও ঢাকা সফরকালে একই সতর্কবার্তা দিয়ে গেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেনে হোলেসটাইন রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ‘রাজনৈতিক সঙ্কট’ আখ্যা দিয়ে তা বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর সাংঘাতিক চাপ সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads