নানা বিড়ম্বনা, দুর্ভোগ আর অনিশ্চয়তা যেন পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশি হজযাত্রীদের। প্রতিবারই হজ মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও এসবের সুরাহা হচ্ছে না। দুর্ভোগ নিরসনে সরকার এবার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও কতিপয় অসাধু হজ এজেন্সির প্রতারণা, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে তা আর হয়নি। এবারো তাই যাত্রী সঙ্কটে ফ্লাইট বাতিল, শিডিউল পরিবর্তন ও ফ্লাইট বিলম্বের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া এখনো বিমানের ৬ হাজার টিকেট অবিক্রীত রয়েছে। এদিকে গতবারের মতো এবারো ১৫ শতাংশ হজযাত্রী রিপ্লেসমেন্ট দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাব। তবে ধর্ম মন্ত্রণালয় বলছে, অতিমুনাফার লোভে কিছু এজেন্সি মৃতদের নামও নিবন্ধন করে এখন তাদেরই রিপ্লেসমেন্ট চাইছে।
হজ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৮ জনের হজে যাওয়ার কথা। সরকারি হিসাবে, গত মঙ্গলবার ৩১ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত সাউদিয়া ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ২১২টি ফ্লাইটে সৌদি আরব গেছেন ৭৪ হাজার ৭১৫ জন হজযাত্রী। তাদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩ হাজার ২২৬ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৭১ হাজার ৪৮৯ জন। এ ছাড়া গতকাল বুধবার ৮টি ফ্লাইটে সৌদি গেছেন আরো অন্তত ৩ হাজার হজযাত্রী। এদিকে সৌদি দূতাবাস ৭ আগস্টের পর আর কোনো ভিসা দেবে না বলে আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এবার বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যে ৫২৮টি এজেন্সি হজ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশত এখনো তাদের যাত্রীদের জন্য ভিসার আবেদনই করেনি। এবার হজের শেষ ফ্লাইট ঢাকা ছাড়বে ১৫ আগস্ট, ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ২৭ আগস্ট।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গতবার হজ মৌসুমে বিরাট ধকল গেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের। অতিমুনাফালোভী কিছু এজেন্সির কারণে হজযাত্রী সঙ্কটে ৩৪টি ফ্লাইট বাতিল ও ১০টির শিডিউল পরিবর্তন করতে হয়। বিলম্বিত ফ্লাইটের কারণে ১০ লাখ রিয়াল জরিমানাও গুনতে হয়। গতবার অসাধু হজ এজেন্সির প্রতারণার কারণে ৩৭৫ জন হজে যেতে পারেননি। এজন্য ৬৬টি এজেন্সির বিরুদ্ধে জরিমানা, জামানত বাজেয়াপ্ত, লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদিও আইনের ফাঁকফোকরের মাধ্যমে ওই এজেন্সিগুলো এবারো ‘হজ বাণিজ্য’ করছে। ২০১৫ সালে ঢাকায় বিমানবন্দরে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় এক হজযাত্রীর মৃত্যু হয়। তার আগে ২০১৪ সালে ফ্লাইট না থাকায় যেতে পারেননি ১৩৩ জন। এসব বাজে অভিজ্ঞতার আলোকে এবার হজ ফ্লাইট পরিচালনায় কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তারপরও যাত্রী সঙ্কটের কারণে হজ ফ্লাইট নিয়ে ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ১৪ জুলাই ফ্লাইট শুরুর পর এ পর্যন্ত পাঁচটি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই বিমান বাংলাদেশ ও সাউদিয়া এয়ারলাইনসের কয়েকটি হজ ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। শেষ ফ্লাইট পর্যন্ত যাত্রী সঙ্কট থাকার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, অতিমুনাফালোভী হজ এজেন্সিগুলো এখনো ফ্লাইট বুকিং নিশ্চিত না করায় শিডিউল করতে পারছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এজন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় বার বার জরুরি নোটিশ জারি এবং জরিমানা আদায়ের হুশিয়ারি দিলেও কোনো লাভ হয়নি। প্রায় ৪০টি হজ এজেন্সি তাদের আড়াই হাজার যাত্রীর অনুকূলে এখনো সৌদিতে বাড়িভাড়াই নিশ্চিত করেনি। যদিও যাত্রীদের কাছ থেকে অনেক আগেই ‘হজ প্যাকেজের’ পুরো টাকা নিয়ে নিয়েছে তারা। ফলে এসব হজযাত্রীর দিন কাটছে দুশ্চিন্তায়। সব মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত বিমানের ৬ হাজার হজযাত্রীর টিকেট অবিক্রীত রয়েছে। এদিকে হজযাত্রীদের যাত্রা নিশ্চিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় এজেন্সিগুলোকে দ্রুত বিমানের টিকেট এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার তাগিদ দিলেও এজেন্সিগুলো দাবি করছে রিপ্লেসমেন্ট কোটা বাড়ানোর। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ৮ শতাংশ রিপ্লেসমেন্টের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা আরো ৭ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ১৫ শতাংশ রিপ্লেসমেন্ট চাইছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবার হজযাত্রী ‘রিপ্লেসমেন্ট’ বা প্রতিস্থাপনের নামে এজেন্সিগুলো ব্যাপক দুর্নীতি করে আসছে। এতে সঠিক সময়ে নিবন্ধন করেও শেষ মুহূর্তে অনেকে হজে যেতে পারেন না। এ বছরও সে পথেই এগুচ্ছে কতিপয় এজেন্সি। তাদের একটি খাজা ট্রাভেলস। কোটা অনুযায়ী ২৫৪ জন হজযাত্রীর জন্য প্রথম দফায় ৪ শতাংশ হিসাবে ১০ জনকে রিপ্লেস করে এই এজেন্সি। পরের দফায় তারা রিপ্লেসমেন্ট চেয়েছে ৭৭ জনের। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, যাদের নিবন্ধন করা হয়েছে তারা টাকা দিতে পারছেন না। ইস্টার্ন ট্রাভেলস নামের আরেকটি এজেন্সি তো ১৭৭ জনের বিপরীতে রিপ্লেসমেন্ট চেয়েছে ৪৭ জনের। সব মিলে ৮ শতাংশের বেশি রিপ্লেসমেন্ট দাবি প্রায় অর্ধশত এজেন্সির। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কিছু অসাধু হজ এজেন্সি আগের মতো এবারো সাড়ে ১০ হাজার ভুয়া যাত্রী নিবন্ধন করে রেখেছে। এখন তাদের পরিবর্তে অন্য লোক নিতে মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছে। মূলত রিপ্লেসমেন্টের নামে বাড়তি টাকায় নতুন হজযাত্রী নেওয়া হবে। সেই ধান্দায়ই আছে তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হজযাত্রী ও হাজী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ড. আবদুল্লাহ আল নাসের বাংলাদেশের খবরকে বলেন, চলতি বছর নিবন্ধন জটিলতাসহ নানা কারণে প্রায় ৪ হাজার হজযাত্রী হজে যেতে পারছেন না। এ কারণে আমরা গত বছরের মতো ১৫ শতাংশ রিপ্লেসমেন্ট দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত বিমান ও সাউদিয়া এয়ারলাইনসের বহু টিকেট অবিক্রীত রয়েছে। রিপ্লেসমেন্টে আর্থিক অনিয়ম হলে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো হজ এজেন্সি যদি সরকারের সর্বনিম্ন হজ প্যাকেজ ৩ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৯ টাকার বেশি নিয়ে রিপ্লেসমেন্ট করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাব মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম মনে করেন, গতবারের মতো এবারো ১৫ শতাংশ রিপ্লেসমেন্ট দেওয়া হলে সব যাত্রীই হজে যেতে পারবেন। বিমানের সিট ফাঁকা থাকবে না। সব টিকেট বিক্রি হয়ে যাবে। তবে দ্রুত ১৫ শতাংশ রিপ্লেসমেন্টের সুযোগ না দেওয়া হলে প্রতিদিনই বিমানের সিট খালি যাবে। কোনো এজেন্সি অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে এজেন্সিগুলোর ‘কিছু চালাকি’ রয়েছে জানিয়ে ধর্ম সচিব আনিছুর রহমান বলেন, বেশি মুনাফার লোভে এবারো কিছু এজেন্সি ভুয়া পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধন দিয়ে হজযাত্রী নিবন্ধন করেছে। মৃত ব্যক্তিদের নামেও নিবন্ধন করেছে তারা। এখন তাদের বিপরীতেই রিপ্লেসমেন্ট চাওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে এজেন্সিগুলো অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, গত ২৫ এপ্রিল নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর অনুসন্ধানে এসব ভুয়া হজযাত্রী ধরা পড়ে। কিন্তু এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে এখন আর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগামী বছর এ ধরনের তৎপরতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) শাকিল মেরাজ বলেন, হজ ফ্লাইট শুরুর পর থেকে প্রথম পর্বে নির্ধারিত সময়েই ঢাকা থেকে সৌদি আরবে হজযাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে ২৪ জুলাই থেকে কিছুটা বিঘ্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, বিমানের প্রায় ৬ হাজার হজযাত্রীর টিকেট এখনো বিক্রি হয়নি। এতে বিমানের হজযাত্রী পরিবহনে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এজন্য এজেন্সিগুলোকে দ্রুত টিকেট ক্রয় করতে বার বার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সাড়া মিলছে না।