• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

আনু মুহাম্মদ

মতামত

পুঁজি যখন ঈশ্বর

  • আনু মুহাম্মদ
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০১৮

দুনিয়ায় এখনও ঈশ্বর শক্তিশালী। নানা ধর্মের নানা ঈশ্বরের সংঘাতও কম নয়। ঈশ্বরের শান্তির বাণী মুখে নিয়ে দেশের পর দেশে মানুষের জীবন ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করার কোনো কমতি নেই। কিন্তু ঈশ্বর শক্তিশালী হলেও দুনিয়া চলে পুঁজির নিয়মে। নিরাকার পুঁজির সাকার রূপ বহুজাতিক সংস্থা, তার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বলপ্রয়োগের জন্য সিআইএ, পেন্টাগন আর সব খুনি বাহিনী, মোলায়েম প্রলেপের জন্য এনজিও। এগুলো এখন দানবের মতো সর্বত্র বিরাজমান, নদীনালা, বিল সমুদ্র বন মাটি বায়ু পশু পাখি আকাশসহ মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্র গ্রাস করেছে। গ্লোবালাইজেশনের এই বিশ্বে মানুষ ক্রমান্বয়ে পুঁজির ক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন হচ্ছে নিজের থেকে, নিজের শ্রম ও মেধা থেকে, পরস্পরের থেকে, নিজবসত থেকে, নিজভূমি থেকে। আবার সম্পর্কিত হচ্ছে পুঁজির নিয়মে, তার নির্দেশনায়।

বর্তমানকালে এসব ঘটনা যেহেতু ঘটে গণতন্ত্র, জনগণের কল্যাণ, দারিদ্র্য বিমোচন এবং ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র নামে সেহেতু এ সময়ে সম্মতি উৎপাদন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। রাজারাজড়ার কালে ক্ষমতাবানরা যে দূরত্বে থাকতো, এখন সে তুলনায় তারা অনেক নিকটে এবং দৃশ্যমান। এই নিকট যে ইলেকট্রনিক মায়ায় বন্দি, তা সহজে চোখে পড়ে না। প্রতিদিন ক্ষমতাবানদের বাণী ও চিত্র মানুষ শোনে ও দেখে। আর তাদের কথা ও সুর যাতে নিজের কথা ও সুর হিসেবে মানুষ ভাবতে শেখে, সেজন্য থাকে বিশাল আয়োজন—শিক্ষা, সংস্কৃতি, এনজিও আর গণমাধ্যমের হুলস্থূল সমাবেশ। বস্তুত আমরা এখন বাস করি বিজ্ঞাপনের রাজ্যে। আমরা বেতার, টিভি, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট, দেয়াল পোস্টার, বিলবোর্ড, ফ্যাশন শো, স্পনসরড নাটক-চলচ্চিত্র-গানের আসর, খেলা, চিত্রাংকন, শিক্ষামেলার মধ্য দিয়ে দিনরাত অতিক্রম করি; আসলে আমরা দেখি আর আত্মস্থ করি বিজ্ঞাপন। রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল, করিম শাহসহ নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সবই এখন বিজ্ঞাপনের বাহন। বহু মেধাবী শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, কবিরা তাঁদের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ অংশটুকু ইজারা দিয়েছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে, কোনো না কোনো পণ্যে ধন্য হওয়ার জন্য মানুষকে প্ররোচিত করার কাজে তা ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে, দেশে দেশে, সারা বিশ্বে এই বিজ্ঞাপনের মধ্যেই গড়ে ওঠে এক বৈশ্বিক ভাষা, স্বাদ, আকাঙ্ক্ষা, প্রেস্টিজ বোধ।

এদের দৃষ্টিতে তারুণ্যের উদ্দামতা কিসে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নয়, জীবনদানে নয়, স্বাধীন জ্ঞানচর্চা মননে শ্রমনিষ্ঠ হওয়ায় নয়, সৃজনশীলতার নৈপুণ্যে নয়, প্রতিবাদী মিছিলে নয়, বোনের কিংবা বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেওয়াতে নয়; তীব্র গরমে বা বর্ষায় বা শীতে দেহের সব পেশি ও স্নায়ুর কর্মক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ দিয়ে চাষবাস, ফসল ফলানো, নদী বা অশান্ত সমুদ্রে মাছ ধরা বা কারখানায় পণ্য উৎপাদন বা মানব পরিবহন তাতেও নয়। তবে কিসে? এই কালের অহি তৈরি হয় বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে, তারুণ্যের উদ্দামতা তৈরি হয় কোকা-কোলা, পেপসি বা অন্য কোনো বিষাক্ত পানীয় পানে, মোবাইলে অনর্গল কথা বললে, নির্ধারিত ফ্যাশন অনুসরণে, গাড়ি বাড়ির নেশায় উন্মত্ত হলে, ফসলের জমি, জলাশয়, বন দখল করে বানানো অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে, পুঁজির সেবায় সৃজনশীলতা ঢেলে দিলে, কোম্পানির সেবায় চৌকস হলে.....শুধু কেনা আর বেচা, বেচা আর কেনায়, ভোগে জীবনের সার্থকতা চিহ্নিত, প্রচারিত। তরুণের জীবনীশক্তি পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয় বাজারের চাহিদার সাথে, ছিনতাই সন্ত্রাসে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ে। তারুণ্যের কৃত্রিম জোশ আনতে কিংবা পরাজয় ভুলতে ভর করে ইয়াবা কিংবা অন্য কোনো নেশায়। ভয়ংকর পুঁজি চাঙা হয়।  

আমাদের খেলার মাঠ, আকাশ, বৃক্ষরাজি দখল করে ভূমিদস্যুরা। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা একাংশ রাস্তায় কিংবা ভয়ঙ্কর কোনো কর্মক্ষেত্রে শৈশব ঢেলে দেয়। আর সচ্ছল অংশ? তারা ঘরের টিভি বা কম্পিউটারে অখাদ্যকে খাদ্য, মিথ্যাকে সত্য, বিষকে মধু হিসেবে শেখে, ভাবতে শেখে।

বিজ্ঞাপন হিসেবে পরিচিত নানা উপায়ের বাইরে জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা ও সাংবাদিকতার জগৎও এখন আরেক রকম বিজ্ঞাপনের বাহন। সারা দুনিয়ায়ই বহুজাতিক সংস্থার এখন পণ্যের মান উন্নয়ন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, প্রযুক্তি বিকাশে যত অর্থ ব্যয় হয়, তার চাইতে বেশি ব্যয় হয় পিআর বা পাবলিক রিলেশনস তৎপরতায়। এর সহজ অর্থ, বিষময় প্রকল্প পাস বা পণ্যবাজার তৈরিতে সরকারি নীতি ও জনমত পক্ষে আনা। পুঁজির জাল, বিদ্যাচর্চা দখলের মধ্য দিয়ে তৈরি করে নাটবল্টু, তাদের নাম বা পরিচয় হতে পারে ‘করপোরেট সেনাবাহিনী’। যে বাহিনীর সদস্যদের ক্যারিয়ার সাফল্য নির্ভর করে আনুগত্য, পুঁজির ফুলে ফেঁপে ওঠায় দক্ষ ভূমিকা পালন, কোম্পানির স্বার্থকে স্বপ্নে জাগরণে নিজের স্বার্থ বলে ভাবতে শেখা আর করপোরেট মস্তিষ্কের ছাঁচে নিজের মস্তিষ্ক তথা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে ক্ষমতার চাইতেও বেশি সচল রাখার ওপর। করপোরেট সেনাবাহিনী বলতে শুধু সিইও থেকে নিম্ন বেতনের কর্মী পর্যন্ত বোঝায় না। আনুষ্ঠানিক কর্মচারী না হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমলা, মন্ত্রী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মকর্তা যে কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার আর লবিস্টদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, বিশ্বব্যাপী যা বিস্তৃত, সেটাও এই করপোরেট সেনাবাহিনীর অংশ।

বর্তমানকালের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর একচেটিয়া বিশ্ব পুঁজির শাসন নিশ্চিত করায় অস্ত্র বহনকারী সেনাবাহিনীর পাশে এই সুশীল সেনাবাহিনীও সদা সক্রিয়। এ বাহিনীই অর্থাৎ কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার আর লবিস্টরাই বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র, অর্থনীতি আর মানুষের জীবনযাপনের প্রধান নীতিনির্ধারক। মানুষ ভোট দিয়ে সরকার বানায়। আর সেই সরকার পরিচালিত হয় সর্বশক্তিমানের এসব প্রতিনিধি দিয়ে, যাদের জনগণ চেনে না, সচরাচর দেখেও না। এদের দেখা যায় মন্ত্রণালয়, দূতাবাস বা বিভিন্ন সংস্থার অফিসে। সন্ধ্যার পর নিয়মিত নানা গোপন বা প্রকাশ্য আনাগোনা বা পার্টিতে এদের প্রীতি সমাবেশ ঘটে।

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ বাঙালি মুসলমানদের রাষ্ট্র। কিন্তু সর্বশক্তিমানের বিধান অনুযায়ী এটি পুঁজির বৈশ্বিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক একটি অঞ্চল। লুণ্ঠন ও দখলে ভাগ বসানো আর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ছাড়া সরকার এবং তার নানা বাহিনীর আর কোনো ভূমিকা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভূমি আর ভূমির নিচের সম্পদও ক্রমান্বয়ে এসব বহুজাতিক পুঁজির দখলে নেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে করপোরেট সেনাবাহিনী। জনগণ এসব খুব কমই অবহিত, তাদের নির্বাচিত সংসদও কিছু জানে না। দৃশ্যমান এসব নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান সবই যেন মায়া। আছে এবং নেই। আসল সিদ্ধান্ত ‘তার’, সবই ‘তার’ ইচ্ছা যেন।

কিন্তু মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় কেন ভুলবে? যাতে ভোলে সেজন্য বিস্তৃত আয়োজন আছে। একশ টাকা লুণ্ঠনের জন্য অন্তত দুই টাকা বরাদ্দ আছে করপোরেট সেনাবাহিনীর অংশ করপোরেট ‘সুশীল সমাজ’, কনসালট্যান্ট, মিডিয়া পার্টনার, লবিস্টদের জন্য। সংসদ বা মন্ত্রিসভা এই আয়োজনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক চলে, কখনও চলে ক্রসফায়ার, কখনও জারি করে দুর্বৃত্তদের জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশ।

সে কারণে বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে কনসালট্যান্ট বা লবিস্টরা যখন তাদের ‘এমবেডেড’ মিডিয়ার মাধ্যমে ধ্বংসকে উন্নয়ন হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থিত করে, তথাকথিত স্টাডি রিপোর্টে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকে, অবিরাম সংলাপে দারিদ্র্য বিমোচনকে দারিদ্র্য সৃষ্টির বন্দোবস্ত দিয়ে পরিচালিত করে, তখন তা বিজ্ঞাপনেরই আরেকটি রূপ নেয়। উদ্দেশ্য অভিন্ন : ‘সম্মতি উৎপাদন’।

পুঁজিবাদের যে অর্থশাস্ত্র এখন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে আছে, তা ভাববাদী দর্শনের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে তার কট্টর বা মৌলবাদী চেহারাও সৃষ্টি হয়। এই অর্থশাস্ত্র খুবই উদ্দেশ্যমূলকভাবে, সুনির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করতেই একটা নিয়তিবাদের মধ্যে মানুষকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। এই অর্থশাস্ত্র মানুষকে শেখাতে চেষ্টা করে, যা কিছু ঘটছে চারদিকে, এটা এমন একটা শক্তি দ্বারা ঘটছে, তা এক অদৃশ্য শক্তি, সর্বশক্তিমান, সেটা হলো বাজার। এর ওপর কারও হাত নেই, কিছুু করার নেই, কিছু করতে গেলেই অনিষ্ট হবে, মেনে নিতে হবে সবকিছু। ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড’, অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন। এই অদৃশ্য শক্তিতে মানুষের ভূমিকা শূন্য। আমরা যদি নিষ্ক্রিয় থাকার পরামর্শ উপেক্ষা করে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা এই অদৃশ্য শক্তির পেছনে পাবো পুঁজি। হ্যাঁ, পুঁজি তার গতি অনুযায়ী কাজ করছে। একটা নিরাকার শক্তি হিসেবে আমরা ঈশ্বরের কথাও ভাবি; কিন্তু অর্থনীতিতে আমরা নিরাকার শাসক যদি খুঁজতে যাই, সেটা হচ্ছে এই পুঁজি। যে নিরাকারভাবে শাসন করছে এবং কতিপয়ের স্বার্থে মানুষের পৃথিবী বিপর্যস্ত করছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সচল ঈশ্বর হলো এই পুঁজি।

যে অর্থশাস্ত্র আমাদের শেখানো হয়, সেই অর্থশাস্ত্র মুখে স্বীকার না করলেও, একটি নির্দিষ্ট দর্শনে পরিচালিত হয়। এ অর্থশাস্ত্রের দর্শন অনুযায়ী, এই পুঁজিবাদ, যাকে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ নামে সাধারণত অভিহিত করা হয়, সেটাই শেষ কথা। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের মধ্যকার ব্যক্তিস্বার্থের উন্মাদনা, মানুষের মধ্যে হিংস্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, সংঘাত, ধ্বংস কিংবা মানুষের মধ্যকার মানবিক সম্পর্কগুলোর ক্ষয় ইত্যাদি অবধারিত। এ ব্যাপারে মানুষের করার কিছু নেই। এর মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এটাই হচ্ছে মানুষের নিয়তি। অতএব, এটাই হচ্ছে ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’।

এই নিয়তিবাদিতার ওপর ভর করে ক্ষমতাবানরা দাঁড়ায় আর নিজেদের সম্পর্কে দাবি করতে থাকে, তাদের সব বক্তব্যই বস্তুনিষ্ঠ ও বৈজ্ঞানিক। তারা আমাদের বোঝাতে চায়, এটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিকভাবে তারা ধ্বংসাত্মক অমানবিক কিংবা নিয়তিবাদী হতে শেখায়! আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরিচালক বিশ্বব্যাংক কিংবা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সর্দার মার্কিন প্রশাসনের লেখা কথাবার্তা খেয়াল করি, তাহলে দেখব, তারা এ কাজই করে নানা বাগাড়ম্বরের আড়ালে। আমাদের দেশে তাদের সুরে সুর মেলানো ‘বিশেষজ্ঞ’ কনসালট্যান্টরাও বর্তমান যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করি, তাকেই মহিমান্বিত করার চেষ্টায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads