• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

পান্তা ইলিশ

সংগৃহীত

মতামত

পান্তা-ইলিশের আড়ালে বাংলা নববর্ষ

  • প্রকাশিত ১০ এপ্রিল ২০১৮

দৈনন্দিন কাজকর্মের সুবিধার জন্য সারা বছর ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করলেও পহেলা বৈশাখের দিন বাংলা নতুন বছরকে বরণ করার জন্য বাঙালি মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। বছরের এই একটি দিনে সবাই নিজেকে শতভাগ বাঙালি হিসেবে জাহির করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। যারা কোনোদিন বাংলা বর্ষপঞ্জির তারিখ মনে রাখার তাগিদ অনুভব করেন না, তারাও পহেলা বৈশাখ পালন করতে উদগ্রিব হয়ে ওঠেন।

সবার এমন স্বতঃস্ফূর্ততায় পহেলা বৈশাখের ব্যাপ্তি এখন অনেক বেড়েছে। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে পহেলা বৈশাখ এখন একটি সর্বজনীন উৎসব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়ানোর একমাত্র উপলক্ষ এখন পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের এত ডামাডোলের মধ্যেও আমরা দিন দিন এর মূল জায়গা থেকে যেন সরে যাচ্ছি।

একসময় পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল হালখাতা, পুণ্যাহ ও বৈশাখী মেলার জমজমাট আয়োজন। পহেলা বৈশাখের আগের দিন হতো চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব— এগুলো এখন শুধু মুখে মুখে টিকে থাকলেও কাজেকর্মে তেমন নেই। সময়ের প্রয়োজনে হয়তো এসব উৎসব ও রীতি-নীতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। ঐতিহ্যবাহী বৈশাখ পালনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। বৈশাখ পালনে নতুন নতুন পদ্ধতির ভিড়ে পুরনো সব রীতি-নীতি এখন প্রায় ম্লান হতে চলেছে। এখন পহেলা বৈশাখ মানেই যেন পান্তা-ইলিশ। কিন্তু কেন? পান্তা-ইলিশ তো পহেলা বৈশাখের কোনো অংশ নয়। তাছাড়া এটা বৈশাখের প্রচলিত প্রথা বা রীতিও নয়। তাহলে কী কারণে এই পান্তা-ইলিশ নিয়ে এত মাতামাতি!

গ্রামের খেটে খাওয়া প্রান্তিক কৃষিজীবী সমাজে পান্তা খাওয়ার চল ছিল, তবে তা খাওয়া হতো কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ বা কোনো শুঁটকি ভর্তা দিয়ে। কারণ গ্রামের কৃষকদের পক্ষে পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার সাধ্য কমই ছিল। তাছাড়া ইলিশ মাছ এমন কোনো প্রজাতির মাছ নয় যে, গ্রামের ডোবানালায় সহজে পাওয়া যায়। সুতরাং ইলিশ মাছ খেতে হলে গ্রামের কৃষকদের সবসময় নগদ টাকায় হাটবারে কিনে খেতে হতো। আর ক’জন কৃষকের এ সাধ্য ছিল? তাছাড়া বৈশাখ মাস ইলিশের মৌসুম নয়। সুতরাং হাল আমলে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়ার যে লোক দেখানো রীতি চালু হয়েছে, তা পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতি নয়। বাংলা সনের বয়স যেখানে প্রায় ছয়শ’ বছর, সেখানে পান্তা-ইলিশের প্রচলন হয়েছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে। তাহলে কীভাবে এটা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হলো!

আশির দশকে একদল তরুণ-তরুণী অনেকটা ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে আসা মানুষজনকে মাটির সানকিতে ৫০ টাকার বিনিময়ে পান্তা ভাত, কাঁচামরিচ ও ইলিশ মাছের ডিশ পরিবেশন করে। এই অভিনব আইডিয়া পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার পায়। পান্তা-ইলিশের এ নতুন আইডিয়া দেখে একশ্রেণির মানুষ তা হুজুগে গ্রহণ করে আর এভাবেই শুরু হয় পান্তা ইলিশের নামে বৈশাখ উদযাপন। পহেলা বৈশাখ এলেই এখন ইলিশের বাজারে আগুন লেগে যায়। ইলিশ মাছের ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো ক্রেতার গলায় ছুরি চালায় কিন্তু ক্রেতাদের তাতে কোনো আপসোস নেই। পাঁচ টাকার জিনিস ৫০০ টাকায় কিনেও তারা ধন্য। ইলিশ তো পাওয়া গেল, এবার শতভাগ বাঙালি হওয়া যাবে।

অথচ অনেক দরিদ্র মানুষ এদেশে বৈশাখের দিন ঠিকমতো প্রয়োজনীয় খাবারটুকুও জোগাড় করতে পারে না। আর সে দেশেই হাজার হাজার টাকায় ইলিশ কিনে বিলাসী বৈশাখ উদযাপন করা হয়। কত বিচিত্র আমাদের ঐতিহ্য প্রেম! এই বৈশাখেই আইনগতভাবে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে অর্থাৎ এ সময় জাটকা ইলিশ ধরা পড়ে, তাই ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু বৈশাখের পান্তা-ইলিশের জোগান দিতে গিয়ে মুনাফার লোভে জেলেরা আইন ভঙ্গ করে জাটকা নিধনে নেমে পড়ে। লাখ লাখ টন জাটকা নিধন করা হয় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পান্তা-ইলিশ ছাড়া বৈশাখ উদযাপনের কথা বলেছেন। এটা বাঙালির জন্য একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। লাল-সাদা রঙের পোশাক গায়ে জড়িয়ে আর পান্তা-ইলিশের পাবলিসিটি করে কখনো বাঙালি হওয়া যায় না। বাঙালি হতে হলে মনে-প্রাণে বাঙালি হতে হবে।

পহেলা বৈশাখে আমরা আমাদের চিরায়ত অনেক রীতি-নীতি পালন করতে পারি, যেগুলো বংশপরম্পরায় পালন করে এসেছে আমাদের পূর্বপুরুষরা। এদিনে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে খেতে পারি মুড়ি, মুড়কি, খৈ, বাতাসা, কাঁচা আমের ভর্তা, মুড়ির মোয়া, জিলাপিসহ নানা ঐতিহ্যবাহী খাবার। বৈশাখের মেলা থেকে আমরা কিনতে পারি বাঁশের বাঁশি, তালপাতার পাখা। এই তো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি। বাঙালি হিসেবে শেকড়ের কাছে ফিরতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাছে। বাদ দিতে হবে পান্তা-ইলিশের মেকি সংস্কৃতিকে।

হুসাইন রবিউল

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads