• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মৃত্যুঝুঁকিতে পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দা

  • প্রকাশিত ২৫ এপ্রিল ২০১৮

চট্টগ্রাম নগরজুড়ে পাহাড়ের পাদদেশ ছেয়ে আছে শত শত বসতঘর। জেলা প্রশাসনের তালিকায় পাহাড়ের পাদদেশে এখনো আটশ’র বেশি অবৈধ বসতির তালিকা আছে। কাঁচা ও আধাপাকা এসব বসতঘর সরানো যাচ্ছে না কিছুতেই। এপ্রিলের প্রথম দিকে অবৈধ বসতঘর উচ্ছেদ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে বর্ষা কিংবা টানা ভারি বৃষ্টিপাতে বাড়তে পারে মৃত্যুর শঙ্কা। দাবি উঠছে পাদদেশ থেকে সরিয়ে বাসিন্দাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের। কিন্তু পুনর্বাসন এবং পাদদেশ থেকে সরানোর কোনো দাবি বাস্তব রূপ লাভ করতে দেখা যাচ্ছে না। বাসিন্দারা রয়েছেন চরম মৃত্যুঝুঁকিতে। সমপ্রতি জেলা প্রশাসনের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অবৈধ বসতি সরাতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আর দুই মাসের কম সময়ে শুরু হবে বর্ষা মৌসুম। ভারি বর্ষণের মৌসুম ঘনিয়ে আসতে থাকায় চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশের পাহাড়ের পাদদেশে ফের দেখা দিয়েছে মৃত্যুর শঙ্কা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত আটশ’র বেশি পরিবারকে সরাতে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই বলা যায়। প্রতিবছর এপ্রিলের শুরুতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা। এতে সিদ্ধান্ত হয় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে— এমন পাহাড় থেকে বসতিদের উচ্ছেদ করার।

সরেজমিন দেখা যায়, নগরীর আলোচিত তিন পাহাড়েই সবচেয়ে বেশি অবৈধ বসতি। এগুলো হচ্ছে বাটালি হিল, মতিঝর্ণা পাহাড় এবং ইস্পাহানি পাহাড়। এই তিনটি পাহাড়ের পাদদেশে শত শত পরিবার এখনো ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। কবে তাদের নিরাপদ স্থানে সরানো হবে, তা কেউ জানে না। সপ্তাহখানেক আগে পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিয়েছে বাসিন্দারা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাদের সরানো না হলে এবারো প্রবল বর্ষণে প্রাণহানি ঘটতে পারে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাসিন্দারা অনেকটা নিরুপায় হয়ে বাস করছে। বেশিরভাগ লোকজনই বলছেন ঝুপড়ি ঘর ছাড়লে পথে রাত কাটানো ছাড়া উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে পাহাড়ের নিচে বাস করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ব্যবস্থাপনা কমিটি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বহুবার নিয়েছে। কিন্তু তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় বন্ধ করা যাচ্ছে না পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা। বহুবার সিদ্ধান্ত হয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারীদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ফলে এবারের সিদ্ধান্তও কতটা কার্যকর হয়- তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে অন্তত ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর তৎকলীন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে। সুপারিশ প্রণয়ন করে ৩৬টি। ওই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিংবা সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা ২০০৭ সালের ঘটনার পর আরো কয়েকটি বড় ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০১১ সালের ১ জুলাই নগরীর খুলশী টাইগারপাস এলাকায় পাহাড়ের একাংশ ধসে দুই পরিবারের আটজন নিহত হন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণভাবে লোকজন বসবাস করা পাহাড়গুলোর তদারকি চলে ঢিমেতালে। পাহাড়গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েও আছে নানা জটিলতা। এসব পাহাড়ের মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। আবার পাহাড়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। আর এসব এলাকায় ঘরবাড়িও বস্তি নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি ও অনাপত্তি বিষয়টি তদারক করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ওই তিনটি সংস্থার যৌথ কোনো তদারকি নেই পাহাড়গুলোয়। এজন্য পাহাড়গুলো দখল করে বস্তি ‍ও ঝুপড়ি তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। স্বল্প ভাড়ার এসব ঝুপড়িতে বাস করছেন গরিব অসহায় লোকজন।

বাটালি হিল, মতিঝর্ণা পাহাড় এবং ইস্পাহানি পাহাড় ছাড়াও আরো ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এগুলোর মধ্যে আছে সিআরবি পাহাড়, ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন বরিশাল কলোনি পাহাড়, সেকান্দর পাহাড়, সিলিমপুরের পাহাড়, আকবরশাহ সংলগ্ন পাহাড়, বায়েজিদের মোজাফফর নগর পাহাড়, ফিরোজশাহ এলাকার শিপিং করপোরেশনের পাহাড়, আরেফিন নগর পাহাড়, একে খান অ্যান্ড কোম্পানির পাহাড়, ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষের নাসিরাবাদ প্রোপার্টিজ পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়ের পাশে হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিম অংশ, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উত্তর পাশের মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়, লালখান বাজার চানমারী রোড সংলগ্ন মুছা বিন আজহার, জামেয়াতুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়, চট্টেশ্বরী রোডে অবস্থিত জেমস ফিনলের (বর্তমান জেএফ বাংলাদেশ লি.) মালিকানাধীন পাহাড়, ব্লসোম গার্ডেনের পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুলসংলগ্ন পাহাড়, আকবরশাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরিবুল্লাহ শাহ মাজারের পাশে বায়তুল আমান হাউজিং সংলগ্ন পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগি পাহাড়ের দিকে ফুলের দোকানের অংশ ও পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের পাহাড়। এসব পাহাড়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সমন্বয় করে করতে হবে। দেখা যাচ্ছে সরকারি এসব দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। সচেতন জনগণ বর্ষার আগে পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষা ও পাদদেশে বসবাসকারী জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করে।      

 

মাহমুদুল হক আনসারী

প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads