• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
সমকালীন রাজনীতি ও জাতীয় শোক দিবস

পোস্টার-ফেস্টুন রাজনীতি ও সামাজিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

সমকালীন রাজনীতি ও জাতীয় শোক দিবস

  • প্রকাশিত ১৬ আগস্ট ২০১৮

বাঙালির জাতীয় জীবনে ফিরে ফিরে আসে বেদনাদীর্ণ পনেরো আগস্ট, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বজন-পরিজনের শাহাদাতবার্ষিকী। এই দিনে গভীর শ্রদ্ধায় বিগলিতচিত্তে জাতি স্মরণ করেছে শহীদানের স্মৃতি, নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে। শোক-সন্তাপের রেশ এখনো কাটেনি। আসলে ক্যালেন্ডারের পাতায় আগস্ট মাস এলেই বাঙালির মন স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত চেতনা যারা বহন করেন, যারা ইতিহাস সচেতন, পনেরো আগস্টের স্মৃতি তাদের চিত্ত বিদীর্ণ করে, হূদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাদের কাঁধে হারানোর এই বেদনাভার জগদ্দল পাথরের মতো। তারা চোখের জলে পালন করেন দিনটি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ তারই কন্যার নেতৃত্বে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ অগ্রসরমান বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ঠিকানা অভিমুখে— এই দৃশ্য তাদের চোখে আনে আনন্দাশ্রু। কিন্তু এও মিথ্যে নয় যে, সবাই একইভাবে জাতীয় শোক দিবসের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেন না। আর কেউ কেউ তো আছেন এখনো, যাদের মুখেই কেবল বঙ্গবন্ধু। এরাই সুযোগ সন্ধানী, ধূর্ত শৃগালের মতো। এই শ্রেণির কাছে ১৫ আগস্ট যেন উদযাপনের একটি দিন। তারা পুরো আগস্ট মাস শোকের আবরণে উদযাপন করেন। স্বীকার্য কেউ এটা বুঝে করেন, কেউ না বুঝে। জাতীয় শোক দিবস পালনযোগ্য কিন্তু উদযাপনের দিন নয়।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আগস্টের শুরুতেই পোস্টার, ডিজিটাল ব্যানার ও পেনায় সয়লাব হয়ে যায় দেশ, এবারো তা-ই হয়েছে। পোস্টার-ফেস্টুন রাজনীতি ও সামাজিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই পোস্টার-ফেস্টুন কালচার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার মিলার সেন্টারে সংরক্ষিত রেকর্ড অনুযায়ী ১৮২৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে সর্বপ্রথম পোস্টারের ব্যবহার হতে দেখা যায়। সে বছর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন কুইন্সি ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পোস্টারের ব্যবহার করেন। সেবার তিনি নির্বাচিতও হন। তিনি আমেরিকার ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। অবশ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের তথ্য অনুযায়ী,  ১৮৪০ সালের নির্বাচনে উইলিয়াম হেনরি হেরিসন প্রথম পোস্টার ব্যবহার করে প্রচারণা চালান। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় প্রপাগান্ডা চালাতে ভারতের ইংরেজ সরকার পোস্টার ব্যবহার করে। সেগুলোই সম্ভবত এই উপমহাদেশে প্রথম পলিটিক্যাল পোস্টার। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেও টেলিগ্রাম ও পোস্টার ব্যবহার করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপকভাবেই পোস্টারের ব্যবহার হয়েছে। তবে উপমহাদেশের বামপন্থিরাই পোস্টারে নান্দনিক রূপ আনয়ন করে। বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি ছাত্র ইউনিয়ন হাতেলেখা পোস্টারে, দেয়াল লিখনে মনকাড়া সব লেটারিং ব্যবহার করেছে। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও এদের হাতেলেখা পোস্টারগুলো ছিল বাস্তবিকই দৃষ্টিনন্দন। সে সব পোস্টারের ভাষা ও স্লোগানও হতো সাহিত্যিক মূল্যমানসম্পন্ন। আজকাল তো হাতের লেখা পোস্টার তেমন দেখাই যায় না।

অতীতে রাজনৈতিক পোস্টারে ব্যক্তির ছবি ছাপারও একটা ব্যাকরণ ছিল। নির্বাচনে প্রার্থীর ছবি ছাপা হতো। কিন্তু সেই ছবিটি এমন হতো,  যাতে নেতাসুলভ ব্যক্তিত্বটা সহজেই ধরা পড়ে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পোস্টারে, প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহার করা হতো। সত্তর ও তেয়াত্তর সালের নির্বাচনেও এটা করা হয়েছে। আদর্শের প্রতিভূ হিসেবে দলের নেতার ছবি পোস্টারে দেওয়ার একটা রীতি ছিল। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ছবি দিয়েও অনেক রাজনৈতিক পোস্টার হয়েছে। একই দলের একই পোস্টারে দুজন নেতার ছবি দিতে দেখা গেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকেই সম্ভবত প্রথম। দলটির মশাল মার্কা পোস্টারে মেজর (অব.) এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের জোড়া ছবি ছাপা হতো। একই দলের নেতা হিসেবে দুজনের ছবি দেওয়ার একটা নেতিবাচক দিক কিন্তু রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, ওই দলের অবিসংবাদিত কোনো নেতা নেই। একজনের ছবি দিলে আরেকজনের বিট্রে করার সমূহ আশঙ্কা। একটি রাজনৈতিক দলের সুসংবদ্ধতার পথে এর চেয়ে বড় কোনো বাধা থাকতে পারে না। আর এখন কী একটা কাল এলো; অলিতে-গলিতে, রাজপথে, গ্রামে-গঞ্জে শত-সহস্র রঙিন পোস্টার ও ব্যানারে এ বলে আমায় দেখ, সে বলে আমায় দেখ। একেকটি পোস্টার-ব্যানারে কত নেতা, পাতি নেতার নাম-পদবি ও ছবি যে মুদ্রিত থাকতে দেখা যায়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমরা পথচলতি সাধারণ মানুষ কত নাম পড়ব, কত ছবি আর দেখব! দেখে দেখে চক্ষু পেরেশান।

ঠিক আছে, তাতেও আপত্তি নেই। নিজের টাকায় নিজেদের পোস্টারে নিজেদের ছবি ছাপবেন, নাম ফাটাবেন, তাতে কার কি যায় আসে! নাম ফাটাতে কে না চায়! আমরাও কী কম যাই! আগে কলামিস্টরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছদ্মনামে লিখতেন। খুব সিনিয়র এবং যার ছবি লোকে দেখতে চায়— এমন কোনো ব্যক্তিত্ব না হলে ছবি ছাপা হতো না। আর এখন ছবি ছাড়া কলামিস্ট তো বটেই, যিনি পত্রিকায় বাল্যবিবাহ সম্পর্কে দুই-আড়াইশ’ শব্দের অভিমত রচনা করেন, তিনিও আশা করেন যে, তার অতি সুন্দর ছবিটি পত্রিকায় ছাপা হবে এবং তা দেখে লোকে বলবে- আহারে, বাহারে! আর নিয়মিত কোনো প্রফেশনাল কলামিস্ট বা তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কলাম লেখককে যদি ছদ্মনামে লিখতে বলা হয়, তাহলে বলবেন- পলাই, পলাই। এর নাম হচ্ছে কাঙালপনা। দোষ ব্যক্তির নয়, দোষ সময়ের। এই দোষ সমকালীন রাজনৈতিক কালচারের।

নাম কিনতে চাওয়া অপরাধ নয়। তাই বলে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টারে নিজেদের নাম-পদবি ও ছবি প্রচারের প্রতিযোগিতা! জাতীয়ভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত পোস্টার-ব্যানার ছাড়াও হাজার পোস্টার-ব্যানার হয়েছে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে। এসব পোস্টার ও ব্যানারের বেশিরভাগের মধ্যে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের অন্যান্য শহীদের ছবির নিচের দিকে অথবা অন্যপাশে এক বা একাধিক লোকের রঙিন ছবি এবং তাদের নাম-পরিচয়। দেখেছি অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি, এমনকি মন্ত্রী-এমপিও এই প্রবণতার বাইরে থাকতে পারেননি। তারা হয়তো বলবেন যে, এ ধরনের ছবি তাদের অজান্তে কোনো ভক্ত ছেপে দিয়েছে। তাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত সেই অতিভক্তদের ডেকে ভর্ৎসনা করা। মনে রাখা দরকার অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।

আরেকটি জরুরি কথা বলা খুবই দরকার। এবারো দেখলাম ১৫ আগস্ট বিএনপি বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন করেছে। কারো জন্মদিন যদি ১৫ আগস্ট হয়ে থাকে, তাহলে সেটা তিনি তার বিবেচনা অনুযায়ী পালন করবেন, করতেই পারেন। বিএনপি তাদের নেত্রীর জন্মদিন পালন করতে চায়, করবে। কিন্তু জাতীয় শোক দিবস, জাতির জনকের শাহাদাতবার্ষিকীর ব্যাপারে তারা কী বলবেন! এই দিবসটি কি বিএনপি এবং জাতীয়তাবাদী ঘরানার অন্য কোনো দলের পালন করার কোনো দায় নেই! সত্য বটে, বিএনপি পঁচাত্তরে সৃষ্ট সুবিধাক্ষেত্র থেকে উৎপন্ন একটি দল, যেখানে সমাবেশ ঘটেছে কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধীদের। কিন্তু এও অনস্বীকার্য যে, এই পার্টিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল চিন্তা থেকে ছিটকে পড়া বামপন্থি রয়েছেন। এরা দলের উচ্চ পর্যায়ে আছেন, তৃণমূল পর্যায়েও আছেন। ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী হলেও, তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুবিরোধী নন। আর এও অনস্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধু যখন জাতির জনক, তখন তিনি আওয়ামী লীগের একার নন। তিনি গোটা জাতির জনক। বিএনপি এবং এই ঘরানার নেতাকর্মীরা কি কখনো একথা বলবেন যে, তারা এই জাতির কেউ নন! তাদেরও মাতৃভাষা বাংলা, তারাও বাঙালি, পাসপোর্ট তাদের বাংলাদেশি। তাহলে তারা কী করে অস্বীকার করবেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে, জাতীয় শোক দিবসকে? পৃথিবীর এমন কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশ ও দল নেই, যেখানে বা যারা জাতির পিতাকে অস্বীকার করে! আমেরিকার মতভিন্নতা সত্ত্বেও ফাউন্ডিং ফাদারদের কেউ অস্বীকার করেন না, আকারে-প্রকারে, কোনোভাবেই না। প্রতিবেশী ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের সঙ্গে ক্ষমতাসীন বিজেপির সামান্য মিলও নেই। কিন্তু দলগতভাবে এই পার্টি গান্ধীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। বলা হয়ে থাকে, বিএনপির অনেকের মধ্যে পাকিস্তানি ভাব রয়েছে। সেই পাকিস্তানেও তো দলমত নির্বিশেষে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে কায়েদে আযম হিসেবে মান্য করা হয়। তাহলে বাংলাদেশে কেন জাতীয়তাবাদী ঘরানার অন্য কোনো দলের এটি পালন করা অসম্ভব হবে? এ তো রাজনীতির এক ভয়ংকর ভ্রান্তি। এ থেকে অন্তত বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের বেরিয়ে আসা উচিত।

জাতীয় শোক দিবসের এই মাসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পরম করুণাময়ের দরবারে কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করি তাঁর আত্মার চিরশান্তি। কামনা করি ১৫ আগস্টের সব শহীদের রুহের মাগফিরাত। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে ইতিহাস ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতো। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ হতো না।

জাতির জনকের স্বপ্ন-সাধনার স্বরূপ এবং এই মহান ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জীবনবোধ আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং এই মহান নেতার ভাষণগুলো আমাদের বার বার পড়া ও শোনা কর্তব্য। অনন্যসাধারণ লেখা এবং ভাষণে জাতির জনকের মনের বিশালতা এবং প্রগাঢ় দেশপ্রেমের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা বর্তমান ও আগামীর জন্য যেমন শিক্ষণীয়, তেমনি অন্তহীন প্রেরণার উৎস।

ফাইজুস সালেহীন

কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads