• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
টেকসই খাদ্য নিরাপত্তায় ভাসমান বেডে চাষাবাদ

ভাসমান কৃষি মূলত পানিবন্দি কৃষকের জন্য আশীর্বাদ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

টেকসই খাদ্য নিরাপত্তায় ভাসমান বেডে চাষাবাদ

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২০ আগস্ট ২০১৮

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ। কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এ দেশের কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টার শেষ নেই। দেশের নানা সময়ের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এ দেশের চাষিরা মানুষের মুখের আহারের জোগান দিতে চাষাবাদ করে। নদীবিধৌত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, পূর্বাঞ্চলে হাওর, বাঁওড়, খাল, বিল, নদী, নালা বেষ্টিত নিম্নাঞ্চল বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ধরে পানিতে তলিয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা দ্বীপের মতো। চতুর্দিকে পানি আর পানি, মাঝে এক চিলতে বাড়ি কিংবা পাড়া। এরই মধ্যে চাষিরা যুদ্ধ করেই চাষাবাদ করে।

বেঁচে থাকার তাগিদে আদিম যুগে মানুষ যেমন গুহায়, বন-জঙ্গলে বসবাস করে পাথরে পাথরে ঘর্ষণ করে আগুন জ্বালাতে শিখেছে। আবার পাথর ঘষে বল্লম তৈরি করে পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। তেমনি এ দেশের কৃষক শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদে জলমগ্ন জমিতে ভাসমান বেড তৈরি করে চাষাবাদ করছে। মূলত প্রচলিত পদ্ধতির ভাসমান বেডে কেবল গাছের চারা ও অল্প কিছু শাক-সবজি চাষাবাদ করা যেত। নতুন উদ্ভাবিত ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতির বেডে সারা বছর ধরে সব ধরনের শাকসবজি, ফল, লতা জাতীয় সবজি, এমনকি বীজতলা করে চারাও উৎপাদন করা অনেকটাই সহজ হয়েছে। মূলত প্রচলিত পদ্ধতির উৎপত্তি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের চাষিদের হাত ধরেই। ধীরে ধীরে এ পদ্ধতি নাজিরপুরের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ও সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য জেলায় বিস্তৃত হয়েছে।

ভাসমান কৃষি মূলত পানিবন্দি কৃষকের জন্য আশীর্বাদ। এ প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করে চাষিরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাদের জীবনমানেরও সমূহ উন্নতি হচ্ছে। নিজেদের খাবার চাহিদার পর উৎপাদিত কৃষিপণ্য তারা হাট-বাজারে বিক্রি করে সংসারের নানা চাহিদা পূরণ করছেন। মূলত এ পদ্ধতিতে পানির ওপর বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ যেমন কুচরিপানা, দুরালিলতা, কলমিলতা এবং এ জাতীয় নানা জলজ আগাছা স্তরে স্তরে সাজিয়ে এক ধরনের বেড তৈরি করে থাকেন। বেড তৈরির কাজটি সহজ হলেও খুবই যত্নসহকারে করতে হয়। ভাসমান এ পদ্ধতিকে কোনো কোনো জায়গায় ধাপ বলা হয়। ধাপের এ প্রচলন এখন নির্দিষ্ট সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে গোটা দেশেই চালু হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি বিভাগ সনাতন এই পদ্ধতিকে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক টেকসই প্রযুক্তিতে রূপান্তর করায় ভাসমান চাষিদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি এই চাষাবাদের দরুন ভূমিহীন প্রান্তিক চাষিদের ক্ষেতও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে ভূমিহীন কিংবা প্রান্তিক চাষিরা এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে নিজেদের ভাগ্যেরও পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর মধ্যম থেকে নিচু কিংবা অতি নিচু জাতীয় জমি রয়েছে। যা দেশের মোট ভূমির শতকরা প্রায় ২১ শতাংশ। এসব জমির একটি বড় অংশ পতিত থাকে। কৃষি মন্ত্রণালয় এই ভাসমান পদ্ধতির চাষ দেশের ১৩টি জেলায় ২৫টি উপজেলায় ছড়িয়ে দিতে ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওপর। প্রকল্পটির আওতায় নতুন উদ্ভাবিত ভাসমান কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জলমগ্ন বা পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনবে। এতে একদিকে ফসল উৎপদন বাড়বে, অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়ও অবদান রাখবে।

সনাতন পদ্ধতিতে ভাসমান ক্ষেতে কেবল গাছের চারা ও সামান্য কিছু শাক-সবজি উৎপাদন করা যেত। কিন্তু নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবিত ধাপে সারা বছরই সব ধরনের শাক-সবজি, ফলমূল ও লতা জাতীয় সবজিসহ ধানের চারা চাষাবাদ করা সম্ভব হবে। যেহেতু আমাদের জনসংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে এবং এ কারণে খাদ্য চাহিদা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেহেতু নতুন নতুন পদ্ধতির আধুনিক চাষাবাদ করার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত না হলে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করা কঠিন হবে। সঙ্গত কারণে জলমগ্ন পতিত জমিকে সনাতন পদ্ধতির বদলে আধুনিক পদ্ধতিতে ভাসমান বেডে চাষাবাদ করতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা শুধু যথার্থই নয় বরং সঠিক ও সময়োচিত। মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ নানা ধরনের চাষাবাদের কৌশল গ্রহণ করেছে। যেমন এসবের মধ্যে ছাদকৃষি অনন্য। এখন ছাদকৃষির দিকে মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের ‘হূদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাদকৃষিকে গোটা দুনিয়ায় যেভাবে পরিচিত করেছে, তাতে আগামী দিনে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে এবং সবজি, ফলমূলের উৎপাদনের মাধ্যমে মোট চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করা সহজ হবে। অথচ কিছুদিন আগেও ভাবার অনেক বাইরে ছিল যে, মানুষ বাসাবাড়ির ছাদে নিজেদের প্রয়োজনে বাণিজ্যিকভাবে ফলমূল ও সবজির চাষাবাদ করতে পারবে। বর্তমানে মানুষের ধারণা পরিবর্তন হচ্ছে। ছাদকৃষির সম্প্রসারণ, পতিত ছাদে স্বাস্থ্যসম্মত সবজি, ফলমূল, ফুল ও ঔষধি গাছ উৎপাদন করে পরিবারের প্রতিদিনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলছে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য নিজেদের পক্ষে চাষাবাদ করা সম্ভব না হলে, ছাদ বর্গা পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যেতে পারে। পাশাপাশি এখন অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই পাকা ভবন। এসব ভবন সারা বছরই পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়ে ভবনের ছাদে শাক-সবজি, ফলমূল, ঔষধি গাছ, এমনকি ফুলের বাগানও করতে পারে। এসব কাজে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিলে কর্মজীবনে এসব শিক্ষার্থী ছাদবাগান কিংবা বসতবাড়ির খালি জায়গায় চাষাবাদ করে অন্তত নিজেদের পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। পতিত জমি, জলমগ্ন জমি, ভবনের ছাদে কীভাবে চাষাবাদ করা যায়, তা শিক্ষাজীবনে শেখানো হলে কর্মজীবনে তা কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

উপসংহারে এটুকুই বলতে চাই, ছোট্ট ভূখণ্ডের বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ যে হারে কমে যাচ্ছে, সে হারে চাষাবাদের জন্য জলমগ্ন জমি, পতিত জমি, বাসাবাড়ির আঙ্গিনা সরকারি ভবনের ছাদে চাষাবাদের ক্ষেত্রকে আরো সম্প্রসারিত করতে হবে। তাহলে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক খাদ্যের জোগান দেওয়া অনেকাংশেই সহজ হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads