• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
মশলাজাতীয় পণ্য এবং ভোক্তার স্বার্থ

কোরবানি ঈদে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মশলা

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

মশলাজাতীয় পণ্য এবং ভোক্তার স্বার্থ

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০১৮

কোরবানির ঈদ এলেই পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ মশলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ে। বরাবরই সে রকমটি দেখে আসছি। কিন্তু এ বছরের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এ বছর রসুন, পেঁয়াজ, আদার দাম বাড়ার বদলে কিছুটা হলেও কমেছে। যদিও দেশীয় পেঁয়াজ, রসুনের বাজারে সরবরাহ কম এবং আমদানিকৃত পেঁয়াজের তুলনায় দাম একটু বেশি। বেশি থাকা স্বাভাবিক। কারণ মশলাজাতীয় পণ্য থেকে শুরু করে আমাদের দেশে উৎপাদিত সব পণ্যের মান ভালো। ফলে দাম একটু বেশিই থাকে। এবারের ঈদের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পেঁয়াজের বাজার ছিল চড়া। অনুমান করা হচ্ছিল, এবারের কোরবানির ঈদকে ঘিরে পেঁয়াজ আমদানি না হলে সাধারণ ভোক্তাকে অনেক চড়া দামে পেঁয়াজ কিনে খেতে হবে। ফলে ঈদের আগেই আমদানিকৃত পেঁয়াজ, রসুনে বাজার সয়লাব হওয়ায় এখন ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য সরকার ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো পণ্য আমদানি কিংবা রফতানি করে থাকে। কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে- এটাই স্বাভাবিক। এই দিক বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়। সে কারণেই এবার কোরবানির ঈদে পেঁয়াজ, রসুন অনেকটা কম দামেই ভোক্তা সাধারণের পক্ষে কেনা সম্ভব হয়েছে।

যদিও গত কয়েক বছরই সিন্ডিকেট করে কারসাজির মাধ্যমে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। যারা নানা কৌশলে পণ্যের দাম বাড়ায়, সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বরং উল্টো তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে থাকে। ফলে অনেক সময়েই সাধারণ ভোক্তাদের বাড়তি মূল্যে পণ্য কিনে খেতে হয়। এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সাধারণ ভোক্তার স্বার্থে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রত্যক্ষভাবে বাজার মনিটরিং করে অযৌক্তিকভাবে পণ্য মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, সরকার যদি পণ্যমূল্য নিয়ে মাথাব্যথা না দেখায়, তাহলে ভোক্তার কষ্ট বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে প্রতিবছরই কোরবানির ঈদ এলেই পেঁয়াজ, রসুন নিয়ে কারসাজি হয়। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বরাবরই মুনাফালোভী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষকে। একমাত্র দেশীয়ভাবে মশলাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে প্রকৃত অর্থে পেঁয়াজ, রসুনের মতো মশলাজাতীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। সরকার মশলাজাতীয় পণ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাত্র ২ শতাংশ সুদে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করলেও বাস্তবে তফসিলি ব্যাংকগুলো এত স্বল্প সুদে মশলাজাতীয় পণ্যের বিপরীতে ঋণ মঞ্জুরে ততটা আগ্রহ দেখায় না। কারণ সামান্য লাভে পুঁজি খাটাতে হয়। কিন্তু সরকারের তরফে কোন ব্যাংক কতজন কৃষকের অনুকূলে কী পরিমাণ ঋণ মঞ্জুরি দিল, তার মনিটরিং নেই। এ ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণ মঞ্জুরি দিয়ে মশলাজাতীয় পণ্য চাষাবাদ করলে পেঁয়াজ, রসুনের আমদানি কমে আসবে। এ জন্য কৃষি বিভাগকে দাফতরিক দায়িত্বে কোন ব্যাংক কোন কোন কৃষকের অনুকূলে মশলার জন্য ঋণ মঞ্জুরি দিয়েছে, তা সরেজমিনে তদারকি করে নিশ্চিত করতে হবে। যেন মশলা চাষাবাদের ঋণ অন্য খাতে ব্যবহূত না হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে নিশ্চিত করতে হবে, বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট সীমার মশলার ঋণ ব্যাংকসমূহকে বিতরণ করে মাসিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে হবে। আমাদের দেশে আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। ফলে কাগজ কলমে ২ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা আছে সত্য, কিন্তু তার বাস্তবায়ন প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফলে ভালো ভালো উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন কতটুকু হলো, তা অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। অথচ সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান গোটা বিশ্বে এখন তৃতীয় স্থানে। সবজি উৎপাদনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে এবং উৎপাদিত সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার স্থাপন করে সরকারিভাবে স্বল্প ভাড়ায় মজুদের ব্যবস্থা নেওয়া হলে সবজি এবং মশলাজাতীয় পণ্যে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করাও সম্ভব হবে।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। যা প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্থানে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ একসময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই সবজি উৎপাদন হতো। এখন কিন্তু সে চিত্র পাল্টে গেছে। বলতে গেলে, গোটা দেশেই এখন কমবেশি সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ভালো মানের বীজেরও সমস্যা নেই। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে, এই কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে যেমন সবজির উৎপাদন বেড়েছে, তেমনি ভোগও বেড়েছে। আবার সবজি রফতানিও বাড়ছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩৪ শতাংশ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার স্ট্যাটিসটিক্যাল ইয়ারবুক-২০১৩ অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সবজির উৎপাদন বেড়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পরের স্থানটি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ নেপালের। দেশে গত দেড় যুগে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। শুধু সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছরই প্রচুর পরিমাণ সবজি পচে নষ্ট হয়ে যায়। এর বাইরে তো বাড়তি ফলন হলে সবজি চাষিদের উপযুক্ত মূল্যের অভাবে কপাল পোড়ে। এরপরও এ দেশের সবজি চাষিদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় যেভাবে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে সবজি রফতানির পরিমাণও বেড়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পরিশেষে বলতে চাই, যেহেতু সবজি উৎপাদনে আমরা ব্যাপকভাবে সফলতা অর্জন করেছি, সেহেতু মশলাজাতীয় সবজি চাষে সরকারিভাবে আরো পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে এক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা অনেকাংশেই সহজ হবে। এ জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের বিতরণ শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। যেন চাষিরা কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই সহজ শর্তে মশলা চাষের ঋণ পান এবং নির্বিঘ্নে চাষাবাদ করতে পারেন। মশলা উৎপাদনের সক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সবই আছে আমাদের চাষিদের। শুধু পৃষ্ঠপোষকতা ও মনিটরিং ব্যবস্থাকে জোরদার করতে পারলেই মশলাজাতীয় সবজি উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তা না হলে, পেঁয়াজ-রসুনের মতো নিত্যপণ্য আমদানির ধারা রোধ করা কঠিন হবে। ফলে ভোক্তার কষ্ট বাড়তেই থাকবে, যা আমাদের কাম্য নয়।

 

লেখক : সমাজকর্মী

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads