• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
আমাদের খনিজসম্পদ নিয়ে কিছু কথা

খনিজসম্পদ সব দেশে অবশ্যই বিশেষায়িত বিষয়

আর্ট : রাকিব

মতামত

আমাদের খনিজসম্পদ নিয়ে কিছু কথা

  • ইউসুফ শরীফ
  • প্রকাশিত ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রাজধানীর আবাসিক এলাকায় গ্যাসের সঙ্কট— সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে রাস্তা ধরে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন, এসব খবর হরহামেশা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সঞ্চিত কয়লা খনি পদ্ধতি নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হবে, এ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের খবরও দেখা যায়। কখনো কখনো কয়লা নিয়ে যেমন, কঠিন শিলা নিয়েও তেমনি কিছু কিছু অনিয়মের খবর সংবাদপত্রের পাঠকরা পাঠ করেন। চুনাপাথর-নুড়িপাথর- চিনামাটি-সৈকত বালি ইত্যাদি নিয়েও মাঝেমধ্যে ভালোমন্দ খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। দেশে কী কী খনিজসম্পদ সঞ্চিত আছে আর মজুতের পরিমাণইবা কত— তা নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধও কখনো কখনো ছাপা হয়ে থাকে। এসব খবরে দেশে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু খনিজ পদার্থ সঞ্চিত থাকার কথাও বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, কঠিনশিলা, নুড়িপাথর, গণ্ডশিলা, কাচবালি, নির্মাণকাজের বালি, চিনামাটি, ইটের মাটি, পিট, সৈকত বালি ইত্যাদি রয়েছে।

খনিজসম্পদ সঙ্গত কারণেই সব দেশে অবশ্যই বিশেষায়িত বিষয়। এ বিষয়টি বিশেষজ্ঞ-গবেষক-প্রযুক্তিবিদ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ-সংস্থা ও নীতিনির্ধারকদের বিচার-বিবেচনা-মূল্যায়ন এবং কর্ম-তৎপরতাধীন বিষয়। খনিজসম্পদ অনুসন্ধান-জরিপ-সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ ও উত্তোলনযোগ্যতা বা উত্তোলন লাভজনক কি না— জাতীয় প্রয়োজনীয়তার নিরিখ সামনে রেখে ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। তবে উপরে যে ধরনের খবরাদির কথা বলা হয়েছে, তার বেশি সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়— তারা তা জানতেও চান না। তারা শুধু চান, দেশের সম্পদ দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগুক। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ-স্বচ্ছন্দ ও উন্নত হোক।

দুই

বাংলাদেশ মূলত সমতল ভূমির দেশ এবং অবস্থান হিমালয় পর্বতমালার প্রায় দক্ষিণ প্রান্তসীমা ঘেঁষে। উচ্চভূমি সীমিত হলেও এসব উচ্চভূমি এবং প্রান্তিক জায়গাতেই এ যাবৎ বেশিরভাগ খনিজ পদার্থের সন্ধান মিলেছে। আবার সমতল ভূমিতেও মিলছে কিছু কিছু খনিজসম্পদ। এ ছাড়া সাগরে মৎস্যসম্পদ ছাড়া পর্যাপ্ত খনিজসম্পদেরও সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যা-ঝড়ঝঞ্ঝার প্রকোপ থাকলেও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উর্বর ভূমিতে কৃষি আবাদ, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের ফলন ইতোমধ্যে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশটির ভূগর্ভে খনিজ পদার্থ যতটুকুই রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বড় সম্পদ।

বড়-ছোট মিলিয়ে এ যাবৎ দেশে প্রায় দুই ডজন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্যাস মজুতের আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। মজুতের প্রায় চার-পঞ্চমাংশই উত্তোলনযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। এমনও বলা হয়ে থাকে যে, বর্তমানে দেশে ব্যবহূত মোট বাণিজ্যিক জ্বালানির বড় অংশ প্রাকৃতিক গ্যাস থেকেই মেটানো যাচ্ছে। ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ খাতে প্রাকৃতিক গ্যাস সর্বাধিক ব্যবহূত হচ্ছে। গ্যাস ব্যবহারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সার কারখানাগুলো। এরপর রয়েছে শিল্প, গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য খাত।

সিলেটের হরিপুরে ১৯৮৬ সালে দেশের একমাত্র খনিজ তেলক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়। এখানে তেলের মজুত প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল বলে উল্লেখ করা হলেও উৎপাদনযোগ্য এর অর্ধেকের একটু বেশি। এই তেলক্ষেত্রে উৎপাদন পরের বছর শুরু হলেও প্রায় ছয় বছর পর থেকে উৎপাদন স্থগিত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে খবরাদিতে এমনও বলা হয়েছে যে, সঠিকভাবে মূল্যায়নকার্য পরিচালনার পর হরিপুর তেলক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। আরো দুটি গ্যাসক্ষেত্রে তেলবাহী শিলাস্তর পাওয়া গেলেও তা অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভজনক হবে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জরিপকাজ শেষ করতে হবে।

বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর চারটি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম কয়লা আবিষ্কৃত হয়, তবে তা রয়েছে অনেক বেশি গভীরতায়। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ কোম্পানি ১৯৯৭ সালে আরো একটি কয়লাখনি আবিষ্কার করে। এখন আবিষ্কৃত কয়লাক্ষেত্র পাঁচটি। অবশ্য এখনো ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লা ইটখোলা ও অন্যান্য শিল্প-কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে, নাকি খনি পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হবে- জাতীয় স্বার্থেই এই বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।

দেশে প্রথম আহরণ করা খনিজসম্পদ চুনাপাথর। টাকেরঘাট এলাকায় চুনাপাথরের একটি ক্ষুদ্র মজুত থেকে চুনাপাথর আহরণ করে তা একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে সরবরাহ করা হয়। এসব ছাড়াও বিশাল মজুত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কঠিনশিলার। এ খবর নির্মাণসামগ্রীর সঙ্কটপূর্ণ বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাভূমিতে পিটের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মজুত রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ নমুনা থেকে চ্যালকোপাইরাইট, বোনাইট, চ্যালকোসাইট, কোভেলাইন গ্যালেনা স্কালারাইটের মতো ধাতব খনিজের সন্ধান পেয়েছে। নির্মাণকাজের বালি দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর তলদেশে পাওয়া যায়। দালান, সেতু, রাস্তাসহ নানাবিধ নির্মাণকাজে এ বালি ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশ বরাবর উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় পাওয়া যায় নুড়িপাথর। বর্ষাকালে উজান থেকে নদীবাহিত হয়ে আসে এসব নুড়িপাথর। পর্যায়ক্রমে তা-ও ব্যবহূত হচ্ছে।

দেশে ভূপৃষ্ঠের উপরে বা ভূপৃষ্ঠের নিচে চিনামাটি পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য মজুত রয়েছে নেত্রকোনার বিজয়পুর, শেরপুরের ভুরুংগাতেম, চট্টগ্রাম জেলার হাটগাঁও-কাঞ্চনপুর-এলাহাবাদে এবং দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায় ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে। চিনামাটি সিরামিক শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের টেকনাফের সমভূমি উখিয়ার ইনানী ও টেকনাফ সমুদ্রতীরের সাতটি স্থানে সঞ্চিত আছে গণ্ডশিলা। এ ছাড়া গণ্ডশিলার মজুত রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি নদীর তলদেশ ও কাছাকাছি স্থানে। বালিজুরী, শাহজিবাজার ও চৌদ্দগ্রাম, মধ্যপাড়া, বড়পুকুরিয়ায় ভূপৃষ্ঠের উপরে বা সামান্য নিচে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাচবালির মজুত রয়েছে। কক্সবাজার-চট্টগ্রামে সমুদ্রসৈকত ও উপকূল রেখা বরাবর ভারী মণিকের মজুত পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, জিরকন, রুটাইল, গারনেট, লিউকসেন, কায়ানাইট ও মোলাইজাইট ইত্যাদি।

তিন

দেশের সব খনিজসম্পদের পরিমাণই বলতে হয় আনুমানিক। এখন বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, যে পরিমাণ খনিজসম্পদ আছে তা দেশের প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য কি-না এবং যথেষ্ট কি-না। এ পর্যন্ত উত্তোলিত খনিজসম্পদের পুরোটারই সদ্ব্যবহার হচ্ছে, নাকি অসতর্কতার কারণে মূল্যবান খনিজসম্পদগুলোর কিছু অংশ অপচয় হচ্ছে? এসব বিষয় দায়িত্বশীল মহলকে আরো সচেতনভাবে খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে মজুত রয়েছে এমন অনেক খনিজসম্পদ অনেক বছর আগে আবিষ্কৃত হলেও এখন পর্যন্ত উত্তোলন না করে নিজেদের কাজ চালানোর জন্য বেশকিছু খনিজ পদার্থ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যায়। দেশে খনিজসম্পদের মজুত যতটুকুই রয়েছে, যোগ্যতা-দক্ষতার সঙ্গে তার অনুসন্ধান, উত্তোলনযোগ্যতা পরীক্ষা এবং উত্তোলন ও ব্যবহার-মাত্রা নির্ধারণ— এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সন্দেহ নেই। এ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আগামী দুই-আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায় পার হয়ে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত হবে।

খনিজসম্পদগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস সারা দেশে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে অন্যগুলোর ব্যবহার এখনো কম। তবে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, নানা কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয়ও হচ্ছে বেশি। আবাসিক প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে কল-কারখানার উৎপাদন-ব্যবস্থায় গ্যাস কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। তারপরও বলতে হয়, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গ্যাস অপচয় হচ্ছে। এদিকে দ্রুত কার্যকর নজরদারি অপরিহার্য। আবাসিক ক্ষেত্রে ব্যবহূত গ্যাসের অপচয়ই হচ্ছে বেশি। অসচেতন ব্যবহারকারীরা দিয়াশলাইয়ের একটি কাঠি বাঁচাতে গিয়ে প্রায় সারা দিনই চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। শীতকালে ঘর গরম রাখা, শিশুদের কাঁথা-কাপড় শুকানোর মতো তুচ্ছ কাজে মূল্যবান জাতীয় সম্পদ অপচয় হচ্ছে দিনের পর দিন। দ্রুত এ ধরনের অপচয় রোধে আবাসিক-বাণিজ্যিক গ্যাস ব্যবহারকারীদের কার্যকর সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। বিদ্যুতের মতো গ্যাসলাইনে মিটারের ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা গেলে কিছুটা হলেও গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

খনিজসম্পদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হতে পারে যতটা সম্ভব নিজস্ব সম্পদ নিজস্ব লোকবল দিয়ে অনুসন্ধান, জরিপ, উত্তোলন বা আহরণ করা এবং এসব প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ ও তার যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা। দেশের ভূগর্ভস্থ খনিজসম্পদ এককভাবে উত্তোলনের পর্যায়ে পৌঁছা বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সাহায্য নিয়ে কাজ করার বিনিময়ে অমূল্য এসব সম্পদের অনেকটা অংশই তাদের ভাগ দিতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকৃত লাভের বিষয়টি খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

খনিজসম্পদ অনুসন্ধান-জরিপ-আহরণ এবং সুপ্রয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট গবেষকদের উচ্চপর্যায়ে গবেষণা নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসী গবেষক-বিজ্ঞানীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত বাস্তবোচিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে তারা দেশে ফিরে জাতির কল্যাণকর্মে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারেন। সর্বোপরি দলমত নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিককে দেশ-জাতির স্বার্থে খনিজসম্পদ অনুসন্ধান-উত্তোলনসহ সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন বোধ-অনুভূতি বা চিন্তা-চেতনা লালন করতে হবে, যাতে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে খনিজসম্পদের সচেতন ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads