• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
মানহীন ওষুধ নিয়ন্ত্রণে প্রাসঙ্গিক আইন

ভেজাল ওষুধে বেশি ক্ষতির শিকার হয় গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষ

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

মানহীন ওষুধ নিয়ন্ত্রণে প্রাসঙ্গিক আইন

  • প্রকাশিত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অলিউর রহমান ফিরোজ

ওধুষ শিল্পে ভয়াবহ অরাজকতা বিরাজ করছে। মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের ভেজাল দেখলে গা শিউরে ওঠে। ভেজালকারীরা এতটাই বেপরোয়া যে, মানুষের জীবন সংহারের মতো ওষুধ দেশের আনাচেকানাচে অনুমোদনবিহীন ফার্মেসিগুলোতে সরবরাহ করে চলেছে।

এসব ভেজাল ওষুধে বেশি ক্ষতির শিকার হয় গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। ভেজালকারী এবং লাইসেন্সবিহীন ওষুধের বড় চালানগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রির জন্য তারা মূলত টার্গেট করে থাকে। তবে শহরের অনেক দোকানেও মানহীন এবং ভেজাল ওষুধ রাখার খবর পাওয়া যায়। সাধারণ একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভেজালকারীরা এসএমসির ওর-স্যালাইন নকল এবং মানহীন অবস্থায় দেশের মুদি দোকানগুলোতে পর্যন্ত সয়লাব করে ফেলেছে। এগুলো বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে তৈরি করে অবিকল এসএমসির প্যাকেটের মতো মোড়কে তারা বাজারজাত করছে। একটা খাওয়ার স্যালাইন পাতলা পায়খানা এবং শরীরের পানিশূন্যতার জন্য অতি আবশ্যক। সেখানে যদি আটা ও লবণ মিশ্রিত পানি সারা দিন ধরে খাওয়ানো হয়, তাতে রোগীর কী হবে! দেশে সবচেয়ে বেশি ভেজালের শিকার হয় নামিদামি কোম্পানির গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। কারণ, বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এই ওষুধগুলোর। ভেজালকারীরা বেশিরভাগ ওষুধই মিটফোর্ড পাইকারি বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা দেশে বাজারজাত করে থাকে।

সরকার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল ওষুধ তৈরি, মজুত, বিক্রি এবং আমদানি-রফতানিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে এখন ওষুধ রফতানি করছে বাংলাদেশ। অ্যালোপ্যাথিক আইটেমের ২০৮টি ওষুধ কোম্পানি ৩ হাজার ৫৮৮ জেনেরিকের প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ওষুধ বাজারজাত করছে। আবার খোলাবাজারে কোটি কোটি টাকার নকল এবং ভেজাল ওষুধও রয়েছে। যার প্রমাণ মিটফোর্ড থেকে ধরা পড়া প্রায় ২০ কোটি টাকার ওষুধের চালান।

বিদেশে ওষুধ রফতানি করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। কিন্তু দেশে এতদিন শুধু একটা নীতিমালা দিয়ে ওষুধ বাণিজ্য চলত। তাতে ছিল নানা রকমের জটিলতা। তাই সরকার ওষুধে ভেজাল, অবৈধ মজুত রাখলে বা প্রদর্শন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড করারও বিধান করে আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে। অচিরেই তা আইনে পরিণত হবে। জালিয়াতকারীরা মফস্বল জেলাগুলোতে কারখানা তৈরি করে সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধেরও ভেজাল তৈরি করছে। তাতে কিছু লোভী ফার্মেসির মালিক বড় ধরনের কমিশন পেলেও ক্রেতা ঠকছিলেন জবরদস্তিমূলকভাবে। বিশেষ করে শিশুদের ওষুধের আধিক্য বেশি থাকায় ওই কোম্পানিগুলো শিশুদের ওধুষেই ভেজাল বেশি করছে। ভেজাল ওষুধে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক শিশুর জীবনও বিপন্ন হতে বসেছে।

দেশে বক্ষব্যাধির ওষুধের মধ্যে সেরিটাইড নামে একটা ওষুধ আমেরিকা থেকে আনা হয়ে থাকে। দেশের বাজারে ওষুধটি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বিশেষত অ্যাজমায় ওষুধটি অত্যাবশ্যকীয়। এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যখন সেরিটাইড ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন, তখন রোগী সে ওষুধ ছাড়া অন্যটি ব্যবহার করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে হ্যাঁ, কিছু ওষুধ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তা পাশের দেশ ভারত থেকে আনা হয়ে থাকে। মিটফোর্ডের পাইকারি বাজারের মাধ্যমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের নীতিমালায় বাইরের ওষুধ বৈধভাবে আনাটা অনেক জটিল বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে আনার কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। তখনই ওষুধগুলো অবৈধভাবে দেশের বাজারে ঢুকে পড়ে। আর এতে সরকারও রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। পাশের দেশ ভারতে গ্ল্যাস্কোর তৈরি ইনু আমাদের দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তা আসে অবৈধভাবে। ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার মিটফোর্ডেও মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করে। তবে জনবল সঙ্কটের কারণে ওষুধ অধিদফতরের পক্ষে সারা দেশে অভিযান চালানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই দেশের মানুষ ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্যে এতদিন নাকাল হচ্ছিল।

ওষুধ হলো রোগব্যাধিতে জীবন রক্ষার অন্যতম উপাদান। আর তা নিয়ে যারা খেলা করেন, বিত্তবৈভবের মালিক হন, তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া চলবে না। এসব জঘন্য প্রতারককে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। জেনে অবাক হতে হয়, এমন ওষুধ রয়েছে হারবালের- যার মূল্য তালিকা গায়ে লেখা সাড়ে ৩০০ টাকা। তাতে বিক্রেতার কমিশনই ২৫০ টাকা। এসব বিক্রেতার কোনো লাইসেন্স নেই। মফস্বলে কখনো অভিযান চালানো হলেই তারা ফার্মেসি বন্ধ করে কেটে পড়ে। মাঝেমধ্যে দুয়েকজন ধরাও পড়ে।

বর্তমানে ওষুধ নীতিমালাটি আইনের খসড়া অবস্থায় রয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানির বিষয়টি যদি সহজ করা হয়, তাহলে সরকার রাজস্ব পাবে। অনেক সময় দেখা যায়, দেশের কোম্পানির ওষুধই চাহিদামাফিক পাওয়া যায় না। ফার্মেসির মালিকদেরই তা বাড়তি দামে কিনতে হয়। আর বিক্রি করতে হয় নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। সেখানে চাহিদাপূর্ণ বিদেশি ওষুধের জন্য নিয়মনীতির মাধমে আমদানির সহজ পথ তৈরি না করলে সেই ওষুধই দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যে মানুষকে কিনতে হবে। তাতে দেশের রোগীরা সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়বে। নতুন খসড়ায় কোনো ডাক্তার আমদানিকৃত ওষুধের নাম লিখতে পারবেন না বলে উল্লেখ আছে। এখন অতি জরুরি ওষুধটি কীভাবে সংগ্রহ করা হবে। তবে দেশে যে ওষুধ পাওয়া যায়, সেই ওষুধ ব্যবহারেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের আগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে যে ওষুধ পাওয়া যাবে না তা উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

ওষুধ শিল্পের অগ্রগতি সাধনে বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি সনদ মিলেছে বাংলাদেশের। বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে হলে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, এবার ওষুধ আইনে সরকারের প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর একবার ওষুধের দাম হালনাগাদ করতে পারবে। আর বিষয়টি অধিদফতরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে বিধায় ক্রেতারা দামের ব্যাপারে ইচ্ছা করলেই ওয়াকিবহাল হতে পারবে। দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সংখ্যা হবে ২৮৫টি। ইউনানি ওষুধ ২২৩ এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ থাকবে ৩৭০টি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ থাকছে ৩৯টি। তবে আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক এবং ইউনানি ওষুধকেও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads