প্রলয় গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতিত হয়ে নিজেই মামলার আসামি, অভিযোগ আলভীর

ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৭:১০

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় একসময় আতঙ্কের নাম ছিল প্রলয় গ্যাং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে মারামারি, ছিনতাইয়ে জড়িতদের বেছে বেছে সেই গ্যাংয়ের সদস্য বানানো হতো। ২০২৩ সালে প্রলয় গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীর আলভী আরসালান। এখন উল্টো সেই গ্যাং সদস্যদের করা মামলার আসামি আলভী, তার মা ও তার বান্ধবী। বর্তমানে ওই মামলায় এই শিক্ষার্থীর মা কারাগারে। আর আলভী ও তার বান্ধবী গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রলয় গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হন আলভী আরসালান। সেই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তোভোগী এই শিক্ষার্থীর মা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসালটেন্ট ডা. রেহানা আক্তার। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে আসামিদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর ঢাবি কর্তৃপক্ষ কয়েকজন অভিযুক্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।
গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব সেই ঘটনায় উল্টো ডা. রেহেনা, তার সন্তান আলভী ও সেদিন আলভীর সাথে থাকা এক বান্ধবীর নামে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে আছেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী জুবায়ের ইবনে হুমায়ুন ও তাহমিদ ইকবাল মিরাজ। এই তিনজনই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মায়ের করা মামলায় আসামি।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আলভী আরসালন ও তার পিতা অধ্যাপক ডা. মীর মোশাররফ হোসেন। তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান।
সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী ও যুগ্ম সদস্যসচিব মাহবুবুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রলয় গ্যাং সদস্যদের সেই মামলায় ডা. রেহেনাকে গ্রেপ্তার করে। কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকটা মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একমাসেরও বেশি সময় ধরে ডা. রেহেনা কারাগারে আছেন। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচার চান।
সংবাদ সম্মেলনে ডা. মীর মোশাররফ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আমার দুই ছেলে সম্মুখযোদ্ধা ছিল। ছোট ছেলে পুলিশের ছররা গুলিতে আহতও হয়েছেন। আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছি।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার ছেলে ও তার এক বান্ধবী ঘুরতে গিয়েছিল। সেখানে বসে থাকার অপরাধে ছাত্রলীগের কথিত প্রলয় গ্যাং সদস্যদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় তারা। এ ঘটনায় আলভীর মা মামলা করলে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত বছরের অক্টোবরে হঠাৎ করে আমাদেরকে অবগত করানো ছাড়া এই মামলার আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। এরপর আমরা আপিল করি। আপিল করার অপরাধে আসামিরা আমার স্ত্রী, সন্তান ও তার বান্ধবীর নামে মামলা দেয়। অথচ সেদিন তারা ৯-১০ জন মিলে আমার ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। আর এখন তাদেরই মামলায় আমাদের আসামি করা হয়েছে। আর পুলিশও কোনো তদন্ত ছাড়াই এ মামলা গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারি চেম্বার থেকে আমার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। আর আমার ছেলে ও তার বান্ধবীকে খুঁজতে বাসায় পুলিশ যায়। এখন তারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাসায়ও থাকতে পারছে না।
ডা. মীর মোশাররফ বলেন, এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আমার স্ত্রীকে কোর্টে তোলা হলে আদালত আমার স্ত্রীকে জামিন দেয় কিন্তু সাথে সাথে পুলিশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ আগস্ট গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় করা মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে গ্রেপ্তার দেখায়। এর কয়েকদিন পর বংশাল থানায় করা ৫ আগস্টের আরেকটি হত্যা মামলায়ও অজ্ঞাতনামা হিসেবে আমার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার দেখায়। অথচ গত ২৮ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত আমার স্ত্রী হাসপাতালের সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে বাসায় বেডরেস্টে ছিলেন। প্রমাণ হিসেবে হাসপাতাল থেকে কাটানো ছুটির কপিও রয়েছে। এছাড়া, ৪ আগস্ট গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। যেখানে ওই ঘটনায় ১৪৪ ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। সেই তালিকায়ও আমার স্ত্রীর নাম নেই।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনই মানুষকে মাপার একমাত্র টেস্ট। সেই আন্দোলনে আমাদের পরিবার অংশগ্রহণ করেও আজ মিথ্যা মামলায় আমার স্ত্রীকে জেল খাটতে হচ্ছে আর সন্তানকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই হতাশার বিষয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আলভী আরসালান বলেন, বইয়ে পড়েছি ১৯৭১ সালে মায়েরা নাকি ছেলেদের মাথায় পতাকা বেঁধে যুদ্ধে পাঠাতো। সেটি আমি অনুভব করেছি এই জুলাই অভ্যুত্থানে। আমার আম্মুর পা ভাঙা থাকায় নিজে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করতে পারলেও নিজের দুই ছেলেকে মাঠে নামিয়েছে। এখন আমার মা জেলে, আমরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়। আমাদের আন্দোলন ছিল ন্যায়বিচারের জন্য। অথচ এখন আমরাই অন্যায়ের শিকার হচ্ছি।
ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে পাল্টা মামলার বাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব বলেন, হলে থাকতে হলে সবাইকেই ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত থাকতে হয়েছে। সেভাবেই আমরা ছিলাম।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাদের করা মামলাটাই সত্য। ডা. রেহেনা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। সে সময় পুলিশ আমাদের কোনো কথা শুনেনি। তাই আমরা এখন মামলা করেছি।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, আপনি যাদের ব্যাপারে ফোন দিয়েছেন সেই মা ও ছেলে ফ্যাসিস্টের দোসর। তারা দুজনই অপরাধী। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। তবে এগুলো তদন্তের স্বার্থে আমরা প্রকাশ করব না।
ওএফ