• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নতুন রেটে গ্রাহকের সর্বনাশ

ফোনালাপরত এক বৃদ্ধা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

টেলিযোগাযোগ

নতুন রেটে গ্রাহকের সর্বনাশ

মোবাইল অপারেটরদের আয় বাড়বে বছরে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা

  • আলতাফ মাসুদ
  • প্রকাশিত ১৬ আগস্ট ২০১৮

সর্বজনীন সর্বনিম্ন কল রেট পুনর্নির্ধারণের ফলে এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে (অফনেট) ফোনকলের খরচ কমেছে। তবে বেড়েছে একই অপারেটরে (অননেট) কলের খরচ। এর মাধ্যমে গ্রাহকের পকেট কেটে মোবাইল অপারেটরদের উচ্চ মুনাফার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। অধিকাংশ ফোনকল অননেটে হওয়ায় দেশের শীর্ষ তিন মোবাইল অপারেটর বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় করবে। আর ভ্যাটসহ অন্যান্য সারচার্জের কারণে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্বও বাড়বে। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা খোদ বিটিআরসির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সভাপতিত্বে গত ১ আগস্ট এক বৈঠকে সর্বজনীন সর্বনিম্ন কল রেট ৪৫ পয়সা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়, যা ১৪ আগস্ট কার্যকর হয়েছে। এর আগে অননেটে কলের সর্বনিম্ন মূল্য ২৫ পয়সা আর অন্য অপারেটরে অর্থাৎ অফনেটে সর্বনিম্ন খরচ ছিল ৬০ পয়সা। পুনর্নির্ধারণ করা সর্বনিম্ন রেট কার্যকর হওয়ায় অননেট ও অফনেটে প্রতিমিনিট সর্বনিম্ন ৪৫ পয়সায় কল করা যাবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কল রেট হবে প্রতিমিনিট দুই টাকা। আর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন কল রেটের সঙ্গে ভ্যাট এবং অন্যান্য চার্জও যোগ হবে।

অননেট কলের ক্ষেত্রে আয়ের পুরোটাই সংশ্লিষ্ট অপারেটর পায়। অফনেটের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কল রেট ৪৫ পয়সার মধ্যে যে অপারেটর থেকে কল যাবে সে পাবে ৩১ পয়সা, আর যে অপারেটরের নেটওয়ার্কে কল যাবে তারা পাবে ১০ পয়সা ও ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) পাবে ৪ পয়সা।

সর্বজনীন সর্বনিম্ন কল রেট কার্যকরে অননেটে গ্রাহকের ব্যয় বেড়েছে ৮০ শতাংশ। বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, মোবাইল অপারেটরদের আয়ের প্রধান উৎসই হচ্ছে ভয়েস কল। আর এর ৬৯ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত আয় আসে অননেট থেকে। অননেটের সর্বনিম্ন কল রেট বেড়ে যাওয়ায় শুধু গ্রামীণফোনেরই বছরে ২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা আয় বাড়বে। এছাড়া বাংলালিংক ১ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ও রবি ৮৫৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ পেয়েছে।

বিটিআরসি সূত্র বলছে, এখন অননেট কলে সর্বনিম্ন মূল্য কাগজে-কলমে ২৫ পয়সা হলেও প্রকৃতপক্ষে গ্রাহকের খরচ হয় ৪৯ পয়সা। আর অফনেট, অর্থাৎ অন্য অপারেটরে কল করার খরচ পড়ে ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। একক কল রেট চালু হওয়ায় অননেট কলের খরচ ৩০ থেকে ৩৫ পয়সা বেড়েছে; কিন্তু অফনেট কলের খরচ কমেছে ৪৫ থেকে ৫০ পয়সা।

বিটিআরসির এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অননেটে যত কল হয়, তার ৫৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ গ্রামীণফোনের। এর বাইরে বাংলালিংকের ২৫ দশমিক ৪৪, রবির ২০ দশমিক ৪ ও টেলিটকের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ কল হয়।

বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা অননেটে গড়ে প্রতি মাসে ১ হাজার ২৩০ কোটি মিনিট কথা বলেন। এতে আগের ২৫ পয়সার বদলে বর্তমানের ৪৫ পয়সা সর্বনিম্ন কল রেট হওয়ায় গ্রামীণফোনের আয় বাড়বে বছরে ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। অবশ্য প্রকৃত আয় আরো অনেক বেশি হবে। কারণ, পূর্বের সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা প্রতিমিনিট কল রেটে গ্রাহকের প্রকৃত ব্যয় হতো গড়ে প্রায় ৪৯ পয়সা। এখন ৪৫ পয়সা সর্বনিম্ন কল রেট ধার্য করায় আনুপাতিক হারে গ্রাহকের ব্যয় বাড়বে। এতে মোবাইল অপারেটরদের আয়ে দেখা দেবে উল্লম্ফন।

অননেটে আয় বাড়লেও কমবে অফনেটে; তবে তুলনায় তা সামান্যই। গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা অন্যান্য অপারেটরে প্রতি মাসে গড়ে ১৩১ কোটি ৯৩ লাখ মিনিট কথা বলেন। আর অন্য অপারেটরের গ্রাহকরা গ্রামীণফোনে প্রতি মাসে গড়ে ২২৫ কোটি ৪১ লাখ মিনিট কথা বলেন। আয় বণ্টনে বর্তমানের নিয়মানুযায়ী, অফনেট থেকে গ্রামীণফোনের বছরে আয় হবে ৭৬০ কোটি টাকা। আগে অফনেটের ৬০ পয়সা কল রেটে এ প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে অফনেট থেকে গ্রামীণফোনের আয় কমবে ৩২৮ কোটি টাকা। তবে অননেট ও অফনেট মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত আয় হবে ২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।

অপারেটরটির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে গ্রামীণফোনের রেভিনিউ ছিল ১২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। মোট রেভিনিউর ৯৬ দশমিক ৩২ শতাংশ আসে মোবাইল কমিউনিকেশন (ভয়েস কল, ডাটা, সাবস্ক্রিপশন, সংযোগ ফি ও আন্তঃসংযোগ) থেকে। এ সময় মোবাইল কমিউনিকেশন রেভিনিউর ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে ভয়েস কল থেকে। ভয়েস কল থেকে গ্রামীণফোনের ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে আয় বাড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। অবশ্য ভয়েস কলের চেয়ে ডাটায় প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল।

গ্রামীণফোনের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অপারেটরদের থেকে ইনকামিং কল কমায় ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে আন্তঃসংযোগ থেকে আয় কমেছে। অবশ্য ভয়েস কল থেকে রেভিনিউ বেড়েছে। প্রতিবছর মোবাইল কমিউনিকেশন থেকে আয় বাড়ায় নিট মুনাফাও বাড়ছে গ্রামীণফোনের। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির নিট মুনাফা ছিল ১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে ২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

বাংলালিংকের গ্রাহকরা অননেটে গড়ে প্রতি মাসে ৫৮১ কোটি ৬৮ লাখ মিনিট কল করেন। নতুন কল রেটে শুধু অননেট থেকে অপারেটরটির আয় বাড়বে ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। আর অফনেটে কথা বলার ক্ষেত্রে বাংলালিংকের মার্কেট শেয়ার হচ্ছে ২৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাংলালিংকের গ্রাহকরা প্রতি মাসে গড়ে অন্য অপারেটরের গ্রাহকদের সঙ্গে ১৩৫ কোটি ৮০ লাখ মিনিট কথা বলেন। একইভাবে অন্য অপারেটর থেকে বাংলালিংকে ফোন করে ১২০ কোটি মিনিট কথা বলেন গ্রাহকরা। ৬০ পয়সা সর্বনিম্ন কল রেটে বছরে এর আয় ছিল ৮৭৯ কোটি টাকা। নতুন রেটে অফনেট থেকে বাংলালিংকের আয় বছরে প্রায় ৬৪৯ কোটি টাকায় নেমে আসবে। এতে করে অফনেট থেকে আয় কমবে ২৩০ কোটি টাকা। তবে অননেট ও অফনেট মিলিয়ে আয় বাড়বে ১ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

অফনেটে কলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হিস্যা রবির। অন্য অপারেটরে যত কল করা হয়, তার ৩৪ শতাংশ যায় রবি থেকে। রবির গ্রাহকরা অন্য অপারেটরে ফোন করে মাসে গড়ে ১৬৩ কোটি ৭২ লাখ মিনিট কথা বলেন। অন্য অপারেটর থেকে রবিতে ১৩৩ কোটি ৪৬ লাখ মিনিট কথা বলেন গ্রাহকরা। ৬০ পয়সা সর্বনিম্ন কল রেটে অফনেট থেকে রবির বছরে আয় ছিল ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন রেট ৪৫ পয়সায় নেমে আসায় এর আয় কমবে বছরে ২৬৪ কোটি টাকা। অফনেটে আয় কমলেও অননেটে রবির আয় বাড়বে। রবির গ্রাহকরা গড়ে প্রতি মাসে ৪৬৬ কোটি ৪৪ লাখ মিনিট অননেটে কথা বলেন। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কল রেট বাড়ায় এক বছরে রবির আয় বাড়বে ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। সব মিলে অফনেট ও অননেট থেকে রবির আয় বাড়বে ৮৫৫ কোটি টাকা।

অননেটে টেলিটকের গ্রাহকরা মাসে ৮ কোটি ৭৪ লাখ মিনিট কথা বলেন। নামমাত্র গ্রাহক থাকায় নতুন কল রেটে অননেটে টেলিটকের আয় এক বছরে বাড়বে মাত্র ২০ কোটি টাকা। আর অফনেটে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির আয় বাড়বে ২৫ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন কল রেট পুনর্নির্ধারণের ফলে টেলিটক সব মিলে বছরে ৪৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে পারবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads