• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নকলের ভিড়ে আসল গায়েব

চীনের এসব ভ্রাম্যমান দোকানে ব্রান্ডের নাম বললেই তাৎক্ষণিক মিলে যায় নকল পণ্য অথবা তৈরী করে দেওয়া হয়

বাংলাদেশের খবর

বাংলাদেশ

নকলের ভিড়ে আসল গায়েব

  • সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন
  • প্রকাশিত ২৩ মে ২০১৮

regular_2291_news_1527008132

বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আমদানি বাণিজ্যের বড় একটি অংশই চীনের নিয়ন্ত্রণে। কাউন্টারফিট প্রোডাক্ট, যাকে আমরা জাল বা নকল পণ্য বলে থাকি, তার ৮৫ ভাগেরই উৎস ওই দেশটি। ঢাকার নবাবপুর, মোতালেব প্লাজা, গুলিস্তান, সিদ্দিকবাজার, আলুবাজার, স্টেডিয়ামসহ আরো কয়েকটি মার্কেটের ৯০ ভাগ পণ্য আসে সরাসরি চীন থেকে। দামি ব্র্যান্ডগুলোর জাল ও ধারণাতীত নিম্নমানের এসব পণ্য এরপর চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্বত্র। আর সেগুলো কিনে ক্রেতারা হচ্ছেন প্রতারিত।

পুরান ঢাকার আলুবাজারে প্রায় ৭০ বছর ধরে ব্যবসা করছে সোনালী ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ইতালি, তুরস্ক, আমেরিকা থেকে প্রেসার ভালব আমদানি করে। ব্রয়লারের নিরাপত্তায় প্রয়োজন হয় এই গ্যাস ভালবের। বেশ দুঃখ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাহান কবির বলছিলেন, বাজারে যেদিনই আমাদের প্রেসার ভালব আসে; তার দুই-তিন মাসের মাথায় অবিকল একই জিনিসে নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার ছেয়ে যায়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের আসল ভালবটি নিয়ে চীনের গোয়াংজু শহরে যায়। সেখানে এর নকল বানিয়ে ঢাকার বাজারে এনে বিক্রি করে। আমরা যে ভালবটি বিক্রি করি এক হাজার টাকায়, সেটিরই নকল পাশের দোকানে বিক্রি হয় আট শ টাকায়। আর এসব নকল পণ্য বিক্রি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে।

‘পকেটে টাকা এলেই গোয়াংজু চলো’- এমন একটি কথা চালু আছে নবাবপুর এলাকায়। জানালেন ইলেকট্রিক পণ্যের এক ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের ইলেকট্রিক ফিটিংসের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার নবাবপুরে। মার্কেটটিতে নামিদামি পণ্যের পাশাপাশি রয়েছে নকল জিনিসও। এক্ষেত্রে দায় ক্রেতার। তাকেই দেখে-শুনে-বুঝে কিনতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যবসায়ী আরো জানান, এই নকল পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে স্টেডিয়াম ও নবাবপুর এলাকার চার-পাঁচটি সিন্ডিকেট। ক্ষুদ্র থেকে বড়- সব ধরনের বিনিয়োগ ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একত্রিত হয়। এরপর দুটি বা তিনটি দলে তারা যোগাযোগ করে গোয়াংজুতে বাংলাদেশি এজেন্টদের সঙ্গে। ঢাকার বেশ ক’টি মার্কেটের ব্যবসাই টিকে আছে গোয়াংজুর ওপর। সেখানকার বাংলাদেশি এজেন্টরা চীনের নকল কারবারিদের সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে পণ্যের দাম ঠিক করে। এরপর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা চলে যায়। তারা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের সব মালামাল একত্র করে কম মূল্য দেখিয়ে রফতানি করে বাংলাদেশে।

বিশ্বে যে পরিমাণ অর্থ মোবাইল তৈরিতে বিনিয়োগ হয়, তার চারগুণ বড় মোবাইল এক্সেসরিজের বাজার। বাংলাদেশেও এই সেক্টরটি বেশ বড়। এর মধ্যে রয়েছে মেমোরি কার্ড, বিভিন্ন মোবাইলের ডাইস, ডিসপ্লে, কভার, হেডফোন ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে পেনড্রাইভ, ক্যামেরার মেমোরি কার্ড, ডাটা ক্যাবল, চার্জার।

গোয়াংজুতে একটি বাংলাদেশি সিন্ডিকেটে কাজ করেন মুন্সীগঞ্জের শরীফ উদ্দিন। তিনি বলেন, গোয়াংজুসহ চীনের বিভিন্ন প্রদেশে নকল পণ্য তৈরির হাজার হাজার কারখানা আছে। এগুলোতে দিন-রাত কাজ হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসল পণ্যের নমুনা নিয়ে লোকজন আসেন। তারা স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে অর্ডার করেন। বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি আফ্রিকা থেকেও লোকজন আসেন। জামা জুতো থেকে শুরু করে কসমেটিকস, শিশুখাদ্য, চকোলেট, ইলেকট্রনিক সব পণ্যই নিজের নিজের চাহিদামতো দামে ও ব্র্যান্ডে বানিয়ে নেওয়া যায়।

তাতে কি এসব পণ্যের গুণগত মান বজায় থাকে? এ প্রশ্নে শরীফ উদ্দিনের সরল উত্তর, গরিব দেশগুলো কমদামে পণ্য পেলেই তো হলো। ধরুন একটি আইফোনের দাম ৫০ হাজার টাকা। চায়নার তৈরি নকল ‘হাইফোন’ দেখতে অবিকল আইফোনের মতো। দাম মাত্র ১০ হাজার টাকা। অসুবিধা কী?

কমদামে নিম্নমানের পণ্য কেনার অনেক অসুবিধা আছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সনি র্যাংগসের এক কর্মকর্তা। তার মতে, যেকোনো পণ্যের যৌক্তিক দাম থাকা উচিত উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত। তা ছাড়া পণ্যের বিক্রয়োত্তর সেবা বলেও একটি বিষয় আছে। সব দিক দিয়ে ভোক্তা ঠকে যাচ্ছেন। তার উদাহরণ, ধরুন আপনি সনি টিভি কিনলেন। দেখা গেল সেটি চীনে তৈরি এবং নকল। আপনার ধারণা না থাকায় দোকানদার আসলের দামে নকল টিভিটি গছিয়ে দিল। এটা হররোজ হচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে। আর যদি আপনার ধারণা থাকে, তাহলে দোকানদার বলেই দেবে এই টিভির কোনো ওয়ারেন্টি নেই। অর্থাৎ কেনার তিন দিনের মাথায় নষ্ট হলে এর কোনো রিপ্লেস পাবেন না।

সমপ্রতি জাতিসংঘের প্রকাশিত ‘ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইম’ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে আটক নকল পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই চীনে তৈরি। সবচেয়ে বেশি নকল পণ্য ধরা পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বব্যাপী যে পণ্য বাণিজ্য হয় তার ২ শতাংশই নকল। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও পূর্ব এশিয়ায় নকল পণ্যের বাজারের আকার বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আর এর প্রায় পুরোটাই আসে চীন থেকে।

ইলেকট্রনিক পণ্যের শোরুমের এক ম্যনেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ধরুন ঢাকার এক ব্যবসায়ী গোয়াংজু থেকে এক হাজার পিস মেমোরি কার্ড পকেটে করে নিয়ে এলেন। প্রতি পিস কার্ডের দাম পড়ে ৫ টাকা করে সর্বোচ্চ। আর সেই কার্ডই ঢাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে আড়াই শ টাকায়। এতে ক্ষতি হচ্ছে প্রথমত সরকারের, কারণ এতে শুল্ক মিলছে না। দ্বিতীয়ত ক্ষতি হচ্ছে ভোক্তার, যিনি অনেকগুণ বেশি দাম দিয়ে নিম্নমানের নকল পণ্য কিনছেন। তার ভাষায় এটা কোনো ব্যবসার মধ্যেই পড়ে না। এটা এক ধরনের নৈরাজ্য।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান কেরল অ্যাসোসিয়েটসের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক চার্লস স্কোলজ সম্প্রতি এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চীন যে কেবল সবকিছু তৈরি করতে পারে তা-ই নয়, বরং দেশটি সবকিছুর অবিকল নকলও বানাতে পারে। তিনি বলেন, চীনের এই পণ্য জালিয়াতির কারণে বিশ্বব্যাপী বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ইউএস ডলার সমমূল্যের মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তার মতে, ভোক্তা শুধু লেবেল কিনছেন, গুণগত পণ্য নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের বাজারে সনি, ডুরাসেল ও ইনার্জিজার ব্যাটারির এক-চতুর্থাংশ নকল। আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড টয়লেট্রিজ, হেড অ্যান্ড শোল্ডার্স শ্যাম্পু, জিলেট রেজার, এমনকি স্কিইপি পিনাট বাটারেরও অধিকাংশ পণ্য নকল। মদ ও পারফিউমও নকল হচ্ছে। আর ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য তো আছেই।

যারা এই নকল পণ্যের ব্যবসা করেন তাদের সঙ্গে কথা বলে চীনের কয়েকটি শহরের নাম জানা গেছে। তারই একটি গোয়াংজু। বাংলাদেশে অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ীদের খুব পছন্দের একটি গন্তব্য। হেন নকল জিনিস নেই যা তৈরি হয় না এই শহরে। সাংহাই থেকে সড়কপথে পাঁচ ঘণ্টার দূরত্বে জিমু শহর। এই শহরটিকে ‘ক্ষুদ্র পণ্যের রাজধানী’ বলা হয়ে থাকে। অন্য কথায় জিমুকে নকল পণ্য তৈরির কেন্দ্রও বলা যায়। সেখানে প্রায় ৪০ হাজার পাইকারি দোকান আছে। ২০০০ সালে সাংহাইয়ের শহরতলিতে জিয়ানজিয়ান বাজারটি চালু হয়। জাল পণ্যের এক বিশাল উৎস এটি। হংকং সীমান্তের কাছাকাছি শেনজেন শহরটিও নকল পণ্যের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এসব শহরেই বেশি যান বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads