
ছবি : বাংলাদেশের খবর
বরগুনার তালতলী উপজেলার নলবুনিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে টাকার বিনিময়ে চলছে অবাধ লুটপাট। ঘুষের বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকার ও গাছ কাটার অনুমতি। এসব অনিয়মের সঙ্গে বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়া বিট কার্যালয়টি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যেখানে বন রক্ষার দায়িত্ব বন বিভাগের, সেখানে তাদেরই একটি চক্র বনজ সম্পদ বিক্রি, গবাদিপশু চরানোর অনুমতি দেওয়া এবং গাছ কাটার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তারা বলেন, এই দুর্নীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিট কর্মকর্তা মো. শাওন।
অবৈধ মাছ শিকার ও গাছ নিধনের অভিযোগ
অনুসন্ধানে জানা যায়, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে মাছ শিকার নিষিদ্ধ হলেও সেখানে চরগড়া জাল ব্যবহার করে নির্বিচারে মাছ ধরা হচ্ছে। এ জাল পাততে প্রয়োজন শক্ত খুঁটির, যা সংগ্রহ করা হচ্ছে শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল থেকে গাছ কেটে। আর এই কাজের অনুমতির জন্য প্রতিটি জেলের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে মাছ ধরার অনুমতি। এ ছাড়া প্রতি গবাদিপশুর জন্য ৪০০ টাকা ঘুষ নিয়ে তাদের বনাঞ্চলে চরানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
সংগঠিত চক্র ও টাকার বাণিজ্য
স্থানীয়দের মতে, এই দুর্নীতির অন্যতম ব্যক্তি হলেন বিটের ওয়াচার জাহাঙ্গীর মিয়া। তিনি নিজেকে বন বিভাগের বড় কর্তা হিসেবে পরিচয় দেন এবং টাকা পেলেই অনুমতি দিয়ে দেন সবকিছুতে।
অভিযোগ রয়েছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ১৫-২০টি মূল্যবান গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। স্থানীয়দের নজরে আসলে বিষয়টি দামাচাপা দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর বনের জমি নিজের বলে দাবি করেন। পরে বন বিভাগ গাছ জব্দ করলেও এ বিষয়ে কোনো আইনী ব্যবস্থা নেয়নি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের চরে চরগড়া জাল পেতে মাছ ধরার জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কমবয়সী গাছ কেটে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বনাঞ্চলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে গরু ও ছাগলের পাল, যারা ছোট চারাগাছ নষ্ট করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় কাটা গাছের গোড়া দেখা গেছে।
জেলেদের ভয়ভীতি ও জোরপূর্বক টাকা আদায়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে জানান, প্রতি মৌসুমে ২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। সময় মতো টাকা না দিলে জাহাঙ্গীর তাদের জাল কেটে দেন। এক জেলের ভাষায়, ‘আগে বছরে ১ হাজার টাকা দিতাম, এখন দুই মৌসুমে ৪ হাজার টাকা দিতে হয়। নদীতে মাছ কমলেও ঘুষের পরিমাণ বাড়ছে।’
এদিকে জেলেদের কাছে টাকা দাবি করার জাহাঙ্গীরের একটি ভিডিও আসে প্রতিবেদকের হাতে। ভিডিওতে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘আমরা ওই জায়গায় গিয়ে দেখি জহিরুল (বন প্রহরী) ভাইর সঙ্গে তর্কাতর্কি চলে। টাকার কোনো বিষয় নাই। ওটা ওদের (জেলেদের) একটা ভয় দেখিয়েছি, চাপ সৃষ্টির জন্য।’
সংরক্ষিত বন থেকে গাছ কাটার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ওটা আমার গাছ। আমি পটুয়াখালী থেকে অনুমোদন করে আনছি। সময় পাই না তাই গাছ নিই না।’
ভিডিওর সত্যতা স্বীকার করেন নলবুনিয়া বিটের বাগান মালি উত্তম বাবু ও বন প্রহরি জহিরুল। তবে ঘুষের টাকার দর-কষাকষির বিষয় জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তারা।
এ বিষয়ে নলবুনিয়া বিট কর্মকতা মো. শাওন জানান, বনাঞ্চল লুটপাট করে বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত না। তিনি কিছুই জানেন না। যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে, তবে যাচাই-বাছাই করে দেখবেন।
ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভিডিওর বিষয়ে স্টাফরা আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বন থেকে জাহাঙ্গীরের গাছ কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর ওই জমির মালিকানা দাবি করে গাছ কেটেছে। আমরা বন বিভাগের পক্ষ থেকে গাছ জব্দ করেছি। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
তালতলী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এটিআর/